বৃদ্ধি এখন কোন পথে? পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা

রাজ্যের উন্নয়নে দরকার বলিষ্ঠ প্রশাসন ও নির্ভয় প্রশাসন

 |  6-minute read |   15-06-2018
  • Total Shares

বাংলাদেশের বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নিরিখে দুই বাংলার এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য কী ভাবে হওয়া সম্ভব? ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তথা বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর "হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং" শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯৭১ সাল, যবে পাকিস্তান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ নামকরণ করেছিল, তবে থেকে এখনও পর্যন্ত সে দেশের অর্থনৈতিক ধারা ও বৃদ্ধির ব্যাখ্যা করেছেন।

বাংলাদেশের এই বৃদ্ধি শুধু পুরো বিশ্বকে চমৎকৃত ও স্তম্ভিতই করেনি, বাস্তব হল এখন তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকেও ছাপিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছে। কৌশিক বসু লিখেছেন, "বাংলাদেশের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদন বছরে মোটামুটি ২.৫ শতাংশ পয়েন্ট হিসাবে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এ বছর তারা বৃদ্ধির হারে ভারতকেও ছাপিয়ে যাবে। (প্রাথমিক ভাবে ভারতের ক্ষেত্রে আর্থিক শ্লথগতি দেখা গেলও নীতিগত ক্ষেত্রে অব্যবস্থা দূর করলেই পরিস্থিতি ঘুরে যাবে)। পাকিস্তানের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২% হলেও বাংলাদেশের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তার চেয়ে কম, যা ১.১ শতাংশ, যার অর্থ, বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের তুলনায় বছরে ৩.৩% পয়েন্ট করে বাড়ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে, ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের বিষয়টি সংশোধন করার পরেও, মোট জাতীয় উৎপাদনের মাথাপিছু গড়ে ২০২০ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ।"

body_061518062230.jpg মান্ধাতার আমলের শ্রম আইন ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতিকে রোধ করে রেখেছে

যে দেশটিতে গত ৭০ বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই দেশের নিরিখে এটি একটি বড় সাফল্য তো বটেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কালে বাংলাকে হৃদয়বিদারী ভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া, কোটি কোটি মানুষের জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়। এক দিকে সম্পত্তি ও জীবনহানি, অন্যদিকে ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া—সে যেন এক ধ্বংসের মহাযজ্ঞ, বাংলা ভেঙে গিয়ে তৈরি হল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই বিচ্ছিন্ন অংশের মধ্যে রয়ে গেল ভারত, যার ফলে পাকস্তানের দুটি অংশ কোনও দিনই অভিন্ন হতে পারেনি, যার ফলে ও একই সঙ্গে উর্দুর চেয়ে বাংলার প্রতি বেশি ভালোবাসা থেকে জন্ম নিল বাংলাদেশ। অধুনা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের (পশ্চিম পঞ্চাব) লাহোর, পেশওয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পঞ্জাবী ভাষাভাষীরা ভারতে চলে এসেছিলেন, সে ভাবে মূলত বাঙালি হিন্দুরাই ভারতীয় পরিচয় বজায় রাখার জন্যই পশ্চিমের সীমানা পার করে ভারতে চলে আসেন। বহু রক্তক্ষয়ের পরে জন্ম হল স্বাধীন বাংলাদেশের।

এখন যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তা হল ২০০৬ সাল অবধি যে দেশটিকে ‘দরিদ্র’ ও ‘হতাশাব্যঞ্জক’ বলে তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা আচমকা কী ভাবে এই দৌড় শুরু করে দিল? অন্যদিকে, সামগ্রিক ভাবে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যে ভাবে অর্থনৈতিক উন্নীত হওয়া দরকার ছিল, একেবারেই সেই ভাবে তা হয়নি।

বাংলদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন কৌশিক বসু। বাংলাদেশের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে নারীদেক ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং বিআরএসির মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর ভূমিকা এবং তৃণমূল স্তরে বেশ কয়েকটি উদ্যোগকে সরকারের সহায়তা প্রদান। বয়ন শিল্পের উন্নতিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কারণ।

ভারতের সঙ্গে যদি একটি তুলনামূলক বিচার করা যায় তা হলে আমরা একটি ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব। কৌশিক বসুর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মান্ধাতার আমলের শ্রম আইন ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতিকে রোধ করে রেখেছে। "শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষমতা ও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছ ১৯৪৭ সালের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট, যার ফল আসলে ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি রুখতে বাংলাদেশেরও অবশ্য আরও কঠোর শ্রম আইন প্রণয়ন করা দরকার। ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশ এই আইন বাতিল করে দেওয়ায় এখন বাংলাদেশে শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে কোনও রকম বিধিনিষেধ নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগের প্রথম বলি হল পাটশিল্প, কারণ একদিকে রয়ে গেলেন কৃষকরা আর একদিকে রইল পাটকলগুলি। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করে বামফ্রন্ট সরকার। এই সময়টি পরিচিত হল শ্রমিক ইউনিয়নগুলির জঙ্গি আন্দোলন, লকআউট, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া—যার ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটল না। হাতের কাছে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮১ সালে যেখানে ভারতের মোট শিল্পেৎপাদনের ৯.৮% অবদান ছিল পশ্চিমবঙ্গের, সেখানে ২০০০ সালে তা কমে হয়ে যায় ৫.১%। ক্ষমতা বদল ও নতুন মুখ্যমন্ত্রী আসার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যের অর্থনীতির হাল ফিরতে শুরু করে, যার প্রভাব শিল্পক্ষেত্রেও পড়েছে এবং রাজ্যের মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি হয়েছে। সেই সময় ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২.৮ ডলার আর পশ্চিমবঙ্গের ৬.১ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপরে ভিত্তি করে আমেরিকার নামী প্রতিষ্ঠান দ্য ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের রিপোর্টে ৪.৬ জিডিপি নিয়ে কলকাতা ছিল দ্বিতীয় স্থানে আর ৫.২ জিডিপি নিয়ে চেন্নাই ছিল প্রথম স্থানে।

পশ্চিমবঙ্গ হল ভারতের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। বর্তমান সরকার পূর্বসূরীদের কাছে থেকে যে পরিমাণের বিপুল ঋণের বোঝা পেয়েছিল তা দিয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তৃণমূল আসার পর ঋণের বোঝা কমেছে। কিন্তু এর পরেও ঋণ ও জিডিপির অনুপাতে দেশের মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

২০১২ থেকে ২০১৫ সালের হিসাবে বার্ষিক ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধির হার নিয়ে ভারতে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশশীল অর্থনীতি হল পশ্চিমবঙ্গ। দেশের সবচেয়ে বড় দশটি রাজ্যের অর্থনীতির বিচারে পশ্চিমবঙ্গ এখন রয়েছে মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের পরেই। যদিও এই দ্রুত হারে বৃদ্ধির প্রতিফলন তেমন একটা পড়েনি রাজ্যের কোষাগারে। এ রাজ্যে করবাবদ আয় এখনও অনেক রাজ্যের চেয়েই কম।

পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হল কৃষিক্ষেত্র। ২০১৫-১৬ সালে কৃষি ক্ষেত্রের বিকাশ হয়েছে ৫.৫৫% হারে, যেখানে জাতীয় গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১.১%। ভারতের মধ্যে এই রাজ্যেই সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় কুটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই) রয়েছে এবং গত পাঁচ বছরে এই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণেও রেকর্ড করেছে এই রাজ্যই।

body1_061518062325.jpgক্ষমতা বদল ও নতুন মুখ্যমন্ত্রী আসার পর পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে

জমির অপ্রতুলতার জন্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের বিকাশ ঘটা খুব মুশকিল। সিঙ্গুর আন্দোলনের পরে বামফ্রন্টকে ধরাশায়ী করে এ রাজ্যের চালকের আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আসেন নির্বাচকরা, তিনিও জোর করে জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করে দেন। এর ফলে শিল্পতালুক স্থাপন ও হাইওয়ের মতো পরিকাঠামো বৃদ্ধি মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত ও সীমিত হয়ে পড়ে। ঝাঁ চকচকে পরিসরে বিশাল বাণিজ্য সম্মেলন করলেও শিল্পপতিরা এ রাজ্য নিয়ে কতটা আগ্রহী হবেন, সে কথা সময়ই বলবে।ভারতের গড় আয়ু ৬৮ বছর ও পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৬ বছরকে ছাপিয়ে এখন বাংলাদেশর গড় আয়ু ৭২ বছর হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং বিআরএসি-কেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন কৌশিক বসু। ২০১৫ সালে প্রকাশিত উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকে রানা ও বিপি মিশ্রের ‘এইলিং হেলথ স্টেটাস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিসে’ রাজ্যের স্বাস্থ্য খাতে স্বল্প বরাদ্দের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “এর ফলে সাধারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন: শূন্যপদ ও কর্মীদের অনুপস্থিতি; শহুরে/সমৃদ্ধ এলাকাগুলিতেই সুযোগ-সুবিধা বণ্টন; তৃণমূল স্তরে ওষুধ ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগানের অভাব থাকা এবং কম সংখ্যক কর্মী ও যে ক'জন আছেন তাঁদের উৎসাহের অভাব।”

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশকে এই তিন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি অত্যন্ত অসমান।” প্রতিবেদনটির পরিশেষে বলা হয়েছে, “বিশুদ্ধ পানীয় জল, উপযুক্ত পরিচ্ছন্নতা এবং হয়তো কয়েকটি জরুরি ওষুধের বন্দোবস্ত করতে পারলেই গ্রাম বাংলায় বিপুল সংখ্যায় মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে। গণস্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদণ্ড হল গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা যেখানে অভাব রয়েছে প্রাথমিক পরিকাঠামো, কর্মী ও জরুরি ওষুধের।”বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি অনুরূপ সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে বৃদ্ধি ধরে রাখতে গেলে দুর্নীতি ও অসাম্য দূরীকরণ অত্যন্ত জরুরি আর একই কথা প্রযোজ্য সীমান্তের ওপারের জন্যও। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যা থেকে কোনও দেশের নীতি নির্ধারিত হয় ও পরিবেশ তৈরি হয়। উন্নয়নের লক্ষে সামাজিক বিকাশ ও বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা, তার সাক্ষী রয়েছে বাংলাদেশ। কৌশিক বসু বলেছেন, এই সব বিনিয়োগ যদি একবার বেরিয়ে যায়, তার ফল হবে মারাত্মক খারাপ ও সুদূরপ্রসারী। দামাস্কাস ও বাগদাদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, বিশ্বের সাংস্কৃতিক গবেষণাকেন্দ্র ও আবিষ্কারের কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে গেল যখন ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়াতে শুরু করল। একই কারণে পাকিস্তানের বরাতও একই রকম। তিনি পর্তুগালের উদাহরণও দিয়েছেন, যে দেশ খ্রিস্টীয় উন্মাদনার জন্য বিশ্বব্যাপী আধিপত্য খোয়ায়।

বরাতজোরে বারত এখনও আকর্ষণীয়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র এবং কেন্দ্রে বর্তমানে যে শাসকদল রয়েছে তার নীতির জেরে বার্ষিক বৃদ্ধির গড় হার মোটামুটি ৮% যা যথেষ্ট ভাবে উল্লেখযোগ্য।আবার বাংলায় ফেরা যাক, সরকারের উচিৎ ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অটুট রাখা এবং জাত ও ধর্ম নির্বিশেষে ধর্মীয় উন্মাদনা তাদের নীতির অংশ না করা। বসিরহাট ও রায়গঞ্জে সাম্প্রতিক দাঙ্গা যে কোনও অর্থনীতির ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। উপযুক্ত প্রশাসনই শুধুমাত্র একটি সুরক্ষিত ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করে যথোপযুক্ত বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করতে পারে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

INDRANILL BASU RAY INDRANILL BASU RAY @ibasuray

The author is an interventional cardiac electrophysiologist based in the US.

Comment