পালকি থেকে বাতানুকুল গাড়ি: ঢাকার জনপরিবহণের একাল-সেকাল
বাক্সের মতো দেখতে পালকিই ছিল ঢাকার আদি বাহন
- Total Shares
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ব্রিটিশদের হাত ধরেই শুরু হয় ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় গাড়ি আবির্ভাব। বাক্সের মতো দেখতে পালকিই ছিল ঢাকার আদি বাহন। এর পর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে ঢাকা আসা সহজ হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই ঢাকায় জনবাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যায়। পালকি ও ঘোড়ার গাড়ির হাত ধরে এখন ঢাকার জনপরিবহণে সংযুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। আজকের লেখায় তুলে ধরব ঢাকার জনপরিবহণের একাল ও সেকালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
প্রথম দিকে ঢাকার জনপরিবহণ
ছোট আকারের পালকি বহন করতে চারজন আর বড় আকারের জন্য লাগত আটজন বাহক। প্রথম দিকে এটি ছিল ধনীদের চলাচলের মাধ্যম। পরে সাধারণ মানুষও এর ব্যবহার শুরু করে। আনুষ্ঠানিক কাজ, বিশেষ করে বিয়েতে পালকি ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। রোগী আনা-নেওয়ার কাজেও ব্যবহৃত হতো এটি। বাহন হিসেবে লোকজন রিকশা বেছে নিলে পালকির বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়। ইঞ্জিনচালিত গাড়ি রাস্তায় নামার আগে বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি চলেছে দীর্ঘকাল। ১৭৯০ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া রেজিস্ট্রার থেকে সারা বাংলায় মাত্র ১০ জন ঘোড়ার গাড়ি নির্মাতার সন্ধান পাওয়া যায়। ঘোড়ার গাড়িতে ইঞ্জিন জুড়ে দিয়েই বাংলার প্রথম দিককার মোটরগাড়ির উদ্ভব।
প্রকৃত জনপরিবহণ ব্যবস্থা
প্রকৃত জনপরিবহণ ব্যবস্থার জন্য ঢাকাবাসীকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার কৃতিত্ব ঢাকার আর্মেনি ব্যবসায়ী সিরকোরসের। ১৮৫৬ সালে তিনি ঢাকায় চালু করেন 'টিকা গাড়ি' বা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা।১৮৮৫ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও পরের বছর ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিস্তৃত হয়।
ঢাকার আরেক জনপ্রিয় বাহন 'রিকশা'। কম খরচে চলাচল করা যেত বলে দ্রুত এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা পুরসভার রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৪১ সালে রিকশার সংখ্যা ছিল মোটে ৩৭টি। পরে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে একসময় ঢাকা পরিচিতিই পায় 'রিকশা-নগরী' হিসেবে। সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে রিকশাতেও। মূল কাঠামো ঠিক রেখে সংযুক্ত হয়েছে ইঞ্জিন।
রিকশার পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয় আরেক বাহন 'অটোরিকশা'। পাকিস্তান আমলে চালু হওয়া এই বাহনটি পরিচিতি পায় 'বেবি ট্যাক্সি' নামে। হলুদ আর কালো রঙের এই বেবি ট্যাক্সি ছিল টু স্ট্রোকের। পরিবেশ দূষণের কারণে সরকার ২০০২ সালের পর থেকে এই বাহন ঢাকায় চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপর ঢাকা শহরে চালু হয় প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজিচালিত সবুজ অটোরিকশা।
ঢাকায় বিভিন্ন সময় চালু হয়েছে ট্যাক্সি সার্ভিস। তবে সরকারের যথাযথ দেখভালের অভাবে এটি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।
প্রথম গাড়ী এসেছিল নবাবদের হাত ধরেই !
ঢাকায় প্রথম অটোমোবাইলের চাকা কখন ঘুরেছিল? প্রশ্ন আছে, নেই সঠিক কোনও উত্তর। তবে বিভিন্নজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে অনুমান করা যায়, ঢাকার প্রথম গাড়ি কোনো উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তা বা কোনও জমিদার নিয়ে এসেছিলেন। এইচ এইচ রেনল্ডস প্রথম গাড়িটি বোম্বে থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ১৮৯৮ সালে। আর কলকাতায় আনার কয়েক বছরের মধ্যে মোটরগাড়ি চলে আসে ঢাকায়। সেটাই কি ১৯০৪ সালে? কেননা সে বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছেন স্ত্রী লেডি মেরি কার্জনকে নিয়ে। তাঁদের আগমন উপলক্ষে মনোরম ভাবে সাজানো হল নবাবের শাহবাগের বাগানবাড়ি। আর তড়িঘড়ি করে নবাব বেশ কয়েকটি গাড়ি কিনে আনলেন কলকাতা থেকে। সেই গাড়িবহরের একটিতে লেডি কার্জন গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসলেন, লর্ড কার্জন দাঁড়ালেন পাশে; চারটি গাড়ি সারিবদ্ধ ভাবে বাড়ির সামনের চত্বরে দাঁড় করানো। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের ছবি তুললেন সে সময়ের বিখ্যাত জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিৎস কাপ। ঢাকার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী রয়ে গেল আমাদের জন্য নবাবের মোটরগাড়ি।
তাহলে কি নবাব সলিমুল্লাহর কেনা সেই মোটরগাড়িগুলো ঢাকার প্রথম মোটরগাড়ি? নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও এটা বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদারের মতো এই অঞ্চলের ধনী ব্যক্তিরাও নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অটোমোবাইলকেই।
বিশ শতকের প্রথম থেকেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদাররা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি কেনা শুরু করেছিলেন। তবে ঢাকার সাধারণ জনগণকে নতুন এই যন্ত্রটিতে চড়তে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও কিছুটা সময়। আর সেটার সুযোগ এসে গেল ত্রিশের দশকে জনসাধারণের জন্য ট্যাক্সি সার্ভিসের শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ঢাকায় পাবলিক পরিবহন!
ঢাকায় প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। পরিবহণ ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন অনেকেই। প্রথমদিকে সর্দার মাওলা বকশ, আর ছিলেন হাবিবুর রহমান খান, যাঁর পরিচিতি ছিল এইচ আর খান নামে। মাওলা বকশের গাড়ি চলত ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নয়ারহাট, ঢাকা-মিরপুর, ঢাকা-ডেমরা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। সেকালের ঢাকার বড় মোটর কোম্পানির নাম ছিল মোমিন মোটর ওয়ার্কস, লোকে যাকে 'মোমিন কোম্পানি' বলত। অরফানেজ রোডে ছিল তাদের ওয়ার্কশপ। গোড়ার দিকে বাংলাদেশে প্রথম মোটর মালিক সমিতি গঠিত হয়েছিল ঢাকায়। সমিতির নাম দেওয়া হয়েছিল 'মোটর ভেহিকল অ্যাসোসিয়েশন'। সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খ্বাজা আহসান উল্লাহ্, সহ-সভাপতি ছিলেন সর্দার মাওলা বকশ ও হাবিবুর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সালাহউদ্দিন। সদস্য ছিলেন অতুল দাস, সোলেমান মিয়া প্রমুখ।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় মোটরগাড়ির প্রদর্শনী
একটা সময় মোটরগাড়ির ব্যবহারকারী বেড়ে যাওয়ার কারণে ঢাকায় মোটর ওয়ার্কশপের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। ঢাকার প্রথম মোটর ওয়ার্কশপটির নাম ছিল 'এক্সেল মোটর ওয়ার্কস'। এর অবস্থান ছিল ঢাকার নবাবপুরে। মালিক ছিলেন পুশপ্যান নামের একজন ইংরেজ ভদ্রলোক। ১৯৩১ সালে পুশপ্যান ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে এই ওয়ার্কশপের নতুন মালিক হন ঢাকার সরদার মাওলা বকশ। তিনি এটির নাম বদলে রাখেন 'মেসার্স ইন্ডিয়া অটোমোবাইল ওয়ার্কস'। ঢাকায় তখন এটিই ছিল একমাত্র মোটর রিপেয়ারিং ওয়ার্কশপ।
ঢাকায় মোটর প্রদর্শনী
জুলাই ১৯৪০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনের আঁচ এই ভারতবর্ষেও পাওয়া যাচ্ছে। তখন সস্ত্রীক ঢাকায় এলেন নতুন গভর্নর অব বেঙ্গল স্যার হার্বাট রিড। লেডি হার্বাটের শখ হল, ঢাকায় একটা মোটর প্রদর্শনী করবেন। এর আগে পূর্ববঙ্গে কখনও মোটরগাড়ির প্রদর্শনী হয়নি। গভর্নরের আদেশ বলে কথা। ধনাঢ্য ব্যক্তি, জমিদার ও খানবাহাদুর- যাঁদের গাড়ি আছে, তাঁদের সবাইকে যোগ দিতে হবে এই মোটর প্রদর্শনীতে। সাড়া মিলল। ১৯৪০ সালের ১৯ জুলাই রমনার রেসকোর্সে নানা রঙে ঢঙে সজ্জিত গাড়ি জড়ো হতে লাগল। লেডি হার্বাট প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন। প্রায় ২০টি গাড়ি তাতে ছিল। লেডি হার্বাট ঘুরে দেখলেন সজ্জিত গাড়িগুলো। শেষ পর্যন্ত কাদের সরদারের নতুন অস্টিন গাড়িটিই পেল প্রথম পুরস্কার।
পরিবহণ ব্যবসা
ঢাকার পরিবহণ ব্যবসার পালে হাওয়া লাগল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। কেননা এ অঞ্চলে থাকা মিত্রবাহিনী বিশেষ করে মার্কিন বাহিনী অনেক গাড়ি ও ট্রাক নিলামে বিক্রি করে দেয়। এসব গাড়ি কিনে সেগুলোতে বডি তৈরি করে রূপান্তর করা হয় বাসে। এসব বাসের বডি কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে টিন মুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে অনেকেই এগুলোকে বলত 'মুড়ির টিন'।
বর্তমানের বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি), যা পাকিস্তান আমলে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন, প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। এই কর্পোরেশন ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকায় ব্রিটিশ কোম্পানি গাইয়ের (জিইউওয়াই) ডাবল ডেকার বাস চালু করে। এ বাসগুলো এখন আর দেখা যায় না। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে দোতলা বাস আমদানি করা হয়।
ঢাকার রাস্তায় যান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের একটা শৃঙ্খলা আনতে বসানো হল সিগন্যাল বাতি। ফরাশগঞ্জ এলাকায় ষাটের দশকের গোড়ার দিকে স্থাপন করা হয়েছিল ঢাকার প্রথম সিগন্যাল বাতি। পুরানো ঢাকার মদন সাহা লেনের গলির মাথায় ছিল ছোট পাকা গার্ডরুমের মতো একটি ঘর। সেই ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তার যানবাহনের অবস্থা দেখে সিগন্যাল বাতি নিয়ন্ত্রণ করা হত। ঢাকার দ্বিতীয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছিল পুরানো ঢাকার সদরঘাট এলাকায়।
ঢাকার বর্তমান গণপরিবহন
লোকাল, সিটিং, গেইটলক ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত- ঢাকার প্রায় সব পথেই রয়েছে এরকম বাস সার্ভিস। অনেক রাস্তাতেই আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থা বিআরটিসির দোতলা, লোকাল ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস পরিষেবা।
সাধারণত কাউন্টার বাসের প্রতি যাত্রীদের আস্থা বেশি। বিআরটিসির সার্ভিসও (টিকিট কাউন্টার-সহ এবং ছাড়া) মন্দ নয়। ঢাকার মধ্যে ও শহরতলীতে উল্লেখযোগ্য বাস ও মিনিবাসের যাতায়াত ব্যবস্থা এবং ভাড়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।
বলে রাখা ভালো, যে কোনও কাউন্টার বাস, বিআরটিসি বাস, এসি বাসগুলো সাধারণত সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে। আর লোকাল ও নম্বরযুক্ত বাসগুলো ভোর থেকে প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত চলাচল করে। একই পথে বিভিন্ন পরিবহণে ভাড়ার সামান্য তারতম্য রয়েছে।
বিকল্প পরিবহণ ও মেট্রো: আজিমপুর থেকে মিরপুর ১ এবং একই স্থান থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত রয়েছে মেট্রো ও বিকল্প পরিবহনের গেইট লক বাস।
ঢাকা থেকে শহরতলীতে যাত্রা
মতিঝিল ও গুলিস্তান থেকে সাভার, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ লোকাল, সিটিং, গেইট-লক ও এসি বাস চলাচল করে।
যানজটের শহর ঢাকা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে অটোমোবাইলের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো হাজির হয়েছে এখানে তাদের বাজার ধরতে। রাজধানী ঢাকাতেই আছে এ সব বিখ্যাত ব্র্যান্ড। কেউ তো আবার নিজের পছন্দের অনুযায়ী গাড়ি আনিয়ে নিচ্ছেন বিদেশ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায়। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না সড়ক। ফলে দেখা দিচ্ছে দীর্ঘ যানজট। পৃথিবীর যানজটের শহরের তালিকায় শীর্ষ শহর এখন ঢাকা। অথচ এক শতাব্দী আগে কী কল্পনা করা গিয়েছিল যে ঢাকার অটোমোবাইলের ছবি আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছাবে?