চতুর্দশ শতাব্দীতে কেন মুদ্রা বাতিল করেছিলেন মহম্মদ বিন তুঘলক
তামার বদলে সোনার ধারনা তাঁর চালু করা, এখন কাগজের টাকায় সোনা কেনা যায়
- Total Shares
মহম্মদ বিন তুঘলক। শিশুপাঠ্য ইতিহাসে তাঁকে খামখেয়ালি রাজা বলেই তুলে ধরা হয়েছে। কোথাও তাঁকে বলা হয়েছে পণ্ডিত-মূর্খ। কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ, ধর্ম ও জোতির্বিজ্ঞানে তাঁর আগ্রহ এবং দর্শনশাস্ত্রে তাঁর প্রজ্ঞার কথা সেই সব বইয়ে লেখা ছিল না, যেমন লেখা ছিল না তাঁর মতের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই রাজরোষে পড়া। অনেকে আবার মনে করেন ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে উত্তরাধিকারী হিসাবে ভেবে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
মহম্মদ বিন তুঘলক সিদ্ধান্তের সময় বাস্তব চিন্তা করতেন না, তত্ত্বের উপরে নির্ভর করতেন
চতুর্দশ শতকের এই সুলতানের প্রসঙ্গ উঠলেই দু’টি কথা প্রথমে মনে আসে – একটি হল রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে দেবগিরিতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত (দেবগিরির নাম দিয়েছিলেন দৌলতাবাদ) এবং আরেকটি হল তামার মুদ্রা প্রচলন।
একটা কথা বলে রাখা দরকার, মহম্মদ বিন তুঘলকের বহু আগে ভারতে তামার মুদ্রা ছিল, তাই তিনি তামার মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন এই তথ্য একেবারেই ঠিক নয়। তিনি স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার বদলেও তা চালু করেননি – তিনি স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার ভাঙানি হিসাবে তামার মুদ্রা চালু করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, দেশে তখন সোনা-রুপোর জোগান কম ছিল, তাই তিনি বিকল্প হিসাবে মুদ্রা তৈরির জন্য তামাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
মুদ্রাগুলি ছিল খুবই সাদামাটা। রাজার নামাঙ্কিত মোহর (সিল) এবং সামান্য কয়েকটি লেখা ছিল সেখানে। সেই সব তামার মুদ্রার বিনিময়ে কী পরিমাণ সোনা-রূপার মুদ্রা পাওয়া যাবে তা নির্দিষ্ট ছিল। তাই ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেল জাল মুদ্রা তৈরি, তারপরে তার বদলে সোনা-রূপার মুদ্রা নেওয়া। ব্যবসায়ীরা পড়লেন ফাঁপরে। সকলেই তামার মুদ্রায় কেনাকাটা করতে চান। তামার টাকায় বাজার ভর্তি, অথচ বণিকরা নিচ্ছে না। মানে বিমুদ্রাকরণের পরে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের যা অবস্থা হয়েছিল – সেগুলি যেমন কাগজের টুকরো হয়ে গিয়েছিল, এগুলির অবস্থাও তাই-ই হল, স্রেফ তামার টুকরো।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলের তামার জাল মুদ্রা (ওয়ার্ল্ডডঅফকয়েন.ইইউ)
মহম্মদ বিন তুঘলক পড়লেন সমস্যায়। তিনি তামার মুদ্রা ফিরিয়ে তার বদলে সোনা-রূপোর মুদ্রা দেবেন বলে স্থির করলেন, রাজকোষে থাকা আসল সোনারূপোর মুদ্রা দেওয়া শুরু হল তামার মুদ্রা বা তনখার বদলে। যে সোনা-রূপোর অভাবে তিনি তামার মুদ্রা চালু করলেন, সেই সোনা-রুপো দিয়েই তাঁকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হল।
কোনটা আসল আর কোনটা নকল তা বোঝা দায়। তাই যার কাছে যত জাল মুদ্রা ছিল সে তার বদলে সোনারুপোর মুদ্রা পেয়ে গেল রাজকোষ থেকে। রাজকোষের হাল তখন কী হয়েছিল তা বোধহয় আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। রাজকোষ ফাঁকা হয়ে গেলে রাজত্বের অর্থনীতিও বেহাল হয়ে যায়।
তবে তুঘলক যে তুল্যমূল্যের ধারনার জন্ম দিয়েছিলেন তখন (১৩২৫-৫১) লোকে তা বুঝতে না পারলেও পরবর্তী কালে সেই সেই তুল্যমূল্যের ধারনা তৈরি হয় এবং বাণিজ্যিক ভাবে বিনিময় ছাড়াও সোনার ভাঙানির হিসাব তৈরি হয়।
মহম্মদ বিন তুঘলকের স্বর্ণমুদ্রা (ক্লাসিক্যালনিউমিসম্যাটিকস.কম)
দু’বছর আগে, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ভারতে বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে এই প্রথমবার, তা নয়। ২০১১ সালের ২৯ জুন বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল – খবরের কাগজে লেখালিখিও হয়েছিল, তবে লোকে পাত্তা দেয়নি। ২০১১ সালে ২৫ পয়সা বাজারে ছিলনই না, ২৫ পয়সা কেউ নিতে চাইতেন না। মাস দেড়েক সময় ছিল ব্যাঙ্কে গিয়ে সেগুলি জমা করার। অনেকে সেটুকুও করেননি।
২৫ পয়সা ও তার চেয়ে কম দামি সব খুচরোই বাতিল করা হয় ২০১১ সালের ২৯ জুন। আজ যদি ৫০ পয়সা বিমুদ্রাকরণের কথা ঘোষণা করা হয়, কার উপরে কী প্রভাব পড়বে? অনেকে তো কয়েকবছর হল সেই পয়সাটি কেমন দেখতে সে কথা ভুলে গিয়েছেন। একই সঙ্গে পুরনো আনা-পাইয়ের বিমুদ্রাকরণ ঘটে এই একই দিনে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে ১৯৪৬ সালে ১০০০ টাকা ও তার চেয়ে বেশি দামের মুদ্রা বাতিল করা হয়। সেই সময় ১০০০ টাকা কতজন দেখেছিলেন বলা মুশকিল। ১৯৭৮ সালেও যখন বিমুদ্রাকরণ করা হয় তখনও ওই বিশাল অঙ্কের নোট সাধারণ লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। তাই সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। সে বার ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে বিমুদ্রাকরণে বাতিল হয় এই নোটটি
বিন তুঘলকের সময়ে হোক, ব্রিটিশ শাসনের শেষে হোক বা ১৯৭৮ সালে, তিন বারই বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল জাল মুদ্রা বাতিল করার জন্য। ২০১৬ সালেও বিমুদ্রাকরণের কারণ হিসাবে তাই-ই বলা হয়েছিল যদিও তখন কালোটাকাও একটি কারণ ছিল।
বিমুদ্রাকরণের পরে একটি কথা ঘোষণা করা হয়েছিল – বাজারে থাকা প্রায় সব টাকাই ফেরত এসেছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। তাতে কালোটাকা উদ্ধার হল কি না তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, তবে ১০০০ ও ৫০০ টাকার জাল নোট যন্ত্রের সাহায্যে ধরা সম্ভব, তাই সেই সময় ১০০০ ও ৫০০ টাকার পুরনো সব জাল নোট নষ্ট হয়েছে। কোনও কিছু যাচাই না করেই এ কথা বলা যায়।
বিমুদ্রাকরণ ঘটেছে ১৯৭৮ সালে
ভারতে অবশ্য আরও নানা ভাবে বিমুদ্রাকরণ হয়েছে। এক রাজা অন্য দেশ দখল করলেই সেখানকার মুদ্রা বাতিল করে দিতেন। সব মুদ্রা বাতিল করা সম্ভব না হলে তার উপরে নিজের মুদ্রার ছাপ মেরে দিতেন। বিমুদ্রাকরণ এ দেশে বহুবার হয়েছে, হইচই বেশি হয়েছে ২০১৬ সালে।