পাঁচশো টাকায় সীমান্ত পার রোহিঙ্গাদের, রেলভ্রমণ পরিচয়পত্র ছাড়াই
ওই টাকাটি খরচ করে এ দেশে রোহিঙ্গা কেন, সন্ত্রাসবাদীরা ঢুকে পড়লেও কিছু করার নেই
- Total Shares
শ’দুয়েক লোক, তার মধ্যে পুরুষ, নারী ও শিশু কতজন করে, সেই সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। রাজ্যের বিপুল জনতার মাঝে মাত্র খান চল্লিশ পরিবারের শ’দুয়েক লোক কত বড় সমস্যা সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের হাড়দহ গ্রামে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল, এ দেশে নিরাপত্তা কতটা ঢিলেঢালা।
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এসে আপাতত হাড়দহ ও জীবনতলায় রয়েছেন রোহিঙ্গারা। নূর সালাম নামে একজনের সঙ্গে কথা বলতেই ভাঙা হিন্দিতে তিনি বোঝালেন, বৌদ্ধরা হামলা করেছে বলেই তাঁরা দেশ ছেড়েছেন। তারপরে বললেন, হাড়দহে তাঁদের আসার কথা।
নূর সালামের কথায়, রাখাইন থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে তাঁরা স্থানীয় দোকান থেকে মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াট বদলে বাংলাদেশি টাকা নেন। চারজনের জন্য বাংলাদেশি পাঁচশো টাকা দিতে হয়। তারপরে গাড়ি করে ভারত সীমান্তে। সেখানে আবার বাংলাদেশি টাকা বদলে ভারতীয় টাকা করে নেন। সীমান্ত পার করতে ভারতীয় পাঁচশো টাকা দিতে হয়। ভারতে যখন ঢুকলেন, তখন হাতে ভারতীয় ৩,২০০ টাকা। ট্রেনের টিকিট কেটে তাঁরা চলে যান দিল্লিতে। এটা ২০১২ সালের গোড়ার কথা। দিল্লিতে গিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংক্রান্ত নথি পান।
নূর জানিয়েছেন, দুই সীমান্তই তাঁরা পেরিয়েছেন রাতের বেলায়, অন্ধকারে। এ থেকে একটা ব্যাপার বোঝা গেল, ভারতের সীমান্ত পার হতে মাত্র ৫০০ টাকা লাগে। তাই ওই টাকাটি খরচ করে এ দেশে রোহিঙ্গা কেন, সন্ত্রাসবাদীরা ঢুকে পড়লেও কিছু করার নেই। আর হাওড়া থেকে দিল্লি পর্যন্ত ট্রেনে যেতে কোনও পরিচয়পত্র দরকার হল না রোহিঙ্গাদের। এ ভাবে ভারতে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী ঢোকেনি, এমন কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে কি? আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) জঙ্গিরা অন্তত তিরিশটি থানায় আক্রমণ করার পরে ও তাতে অন্তত ১২জন নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু হওয়ায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে রোহিঙ্গা খেদাও শুরু করে মিয়ানমার সেনা। এই ৪০ হাজারের মধ্যে সেই জঙ্গিরা নেই, এ কথা কতটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবে প্রশাসন?
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এসে আপাতত হাড়দহ ও জীবনতলায় রয়েছেন রোহিঙ্গারা
এ রাজ্যে কী ভাবে
দিল্লি থেকে এ রাজ্যে তাঁরা এসেছেন হোসেন গাজি নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে। হোসেন গাজিই নিয়ে গেলেন শরণার্থী শিবিরে। ঘুরিয়ে দেখালেন শিবির। তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, ‘দেশ বাঁচাও সামাজিক কমিটি’ নামে একটি সংগঠনের তিনি সদস্য। সংগঠন মানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তিনি বললেন, “আমরা কোনও রাজনৈতিক দল করি না, তবে এখানে বিজেপিকে ঢুকতে দেব না। কারণ ওরা ভেদাভেদ করে। রোহিঙ্গারা মানুষ, আমরা কোনও ধর্ম দেখি না, শুধু দেখি তারা যেন মানুষের মতো বাঁচতে পারে।”
কিন্তু দিল্লি থেকে ওঁদের কেন এখানে নিয়ে এলেন? তার কোনও সদুত্তর, বলা ভালো, উত্তর পাওয়া যায়নি। হোসেন গাজি বললেন, “এখানে কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা রয়েছেন, আমি তাঁদের হাসপাতালে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমরা সকলের নাগরিকত্ব দাবি করছি।” স্থানীয় এক যুূবক বললেন, "এ বার ওরা এখানে বিয়ে-থা করে থেকে যাবে। ওদের ছেলেপুলেরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে।"
কী ভাবে রয়েছেন ওঁরা
হাড়দহে টিনের ছাউনি করে ওঁরা রয়েছেন, সেখানেই রান্না-খাওয়া। দুপুরের দিকে ওই উদ্বাস্তু শিবিরে অনেক মহিলা ও শিশু ছিল। এখানে ১২ জন শিশু স্কুলে পড়ার উপযুক্ত। হোসেন গাজি জানালেন, পঞ্চায়েত ভোট মিটলেই সকলেই স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে। শিবিরে থাকা জুবেদা বিবি বললেন, “আমরা মা ও মেয়ে থাকি, কোনও পুরুষ নেই। খাওয়ার বন্দোবস্ত হোসেন গাজিই করে দিচ্ছে।”
পুরুষরা কাজ করেন। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই তাদের কাজ জুটিয়ে দিচ্ছে। কয়েক দিন হল নতুন করে শিবির হয়েছে, সেখানে দু’টি পরিবার রয়েছে। সন্ধ্যায় ঘরে বাল্ব জ্বলে। বিদ্যুৎ পান কোথা থেকে? হোসেন গাজি তাড়াতাড়ি বললেন, “আমার বাড়ির মিটার থেকে লাইন দিয়েছি।”
দেশে ফিরবেন কবে
কয়েক মাস পরে বর্ষা। তখন কী হবে এখন সেই ভাবনাই ভাবছেন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা লোকজন। তা হলে দেশে, মানে মিয়ানমারে ফিরবেন কবে? প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না নূর সালাম। তিনি একটু থমকে ভাঙা হিন্দিতে যা বললেন, তার সোজা কথা হল, কবে ফিরবেন জানেন না, ফিরতে চান না। দেশে না ফিরে এখন এ দেশে থেকে যেতে চান, নাগরিক হিসাবে। এখন কাজ চাইছেন।
রাখাইন সমস্যা ও প্রশাসনের ভূমিকা
বিবিসির একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মহিলাকে ধর্ষণ ও খুনের জেরেই সমস্যা শুরু। ২০১২ সালের জুন মাসে রাখাইনে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করে। সেই দাঙ্গায় অন্তত ২০০ জনের মৃত্যু হয় এবং কয়েক হাজার লোক ঘরছাড়া হয়, যাদের সিংহভাগই মুসলমান বলে ধারনা।
পরের বছর মার্চে সেন্ট্রাল মিয়ানমারের মেইকটিলায় একটি সোনার দোকানে বচসাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দাঙ্গা, তাতে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়, পুরো এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়। ২০১৩ সালেই কানবালুতে বৌদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণে অভিযুক্ত মুসলমান যুবককে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হাতে সঁপে না দেওয়ার প্রতিবাদে এলাকায় মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে রাখাইনে এক পুলিশকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাখাইন, রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব অনুয়ায়ী শিশু ও মহিলা-সহ মোট ৪০ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় এই ঘটনায়।
ওই বছর মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে দাঙ্গায় পাঁচ জন আহত হয়, এক বৌদ্ধকে কয়েকজন মুসলমান মিলে ধর্ষণ করেছে, এ কথা রটে যাওয়াতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়।
প্রশাসন প্রথম থেকে দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করেছে, মেইকটিলার ঘটনায় ২০ জন বৌদ্ধ ও ১০ জন মুসলমানের সাজা হয়। কিন্তু অভিযোগ, ২০১৪ সালের জনগণনায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাদ দিয়ে দেয় মিয়ানমার প্রশাসন ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট অনুয়ায়ী, এ বছর জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার সেনা সাতটা এলাকা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হল, এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য তারা এ কাজ করেছে, খুব শীঘ্রই রোহিঙ্গাদের ফেরানো হবে। গত বছর ডিসেম্বর মাসেই রাখাইনের ২০টি গ্রামে সরকার বাড়ি তৈরি করেছে।
তবে সম্প্রতি একটি সংবাদে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের পাহাড়ি ও অরণ্য অঞ্চলে বসবাসকারী মূলত বৌদ্ধ ও অল্প সংখ্যায় খিস্টানদের নাগরিকত্ব, বিনামূল্যে জমি ও আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে মিয়ানমার সরকার।
হাড়দহে টিনের ছাউনি করে ওঁরা রয়েছেন, সেখানেই রান্না-খাওয়া
রোহিঙ্গাদের পরিচয়
রাষ্ট্রপুঞ্জের মত অনুয়ায়ী, রোহিঙ্গারা হল পশ্চিম মিয়ানমারে বসবাসকারী ধর্মীয় ও ভাষাগত ভাবে সংখ্যালঘু। দুনিয়ায় তারাই সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। তারা একশো বছরের বেশি সময় ধরে এখানে বসবাস করছে বলে অনেকে দাবি করলেও, মিয়ানমার সরকার সে কথা মানছে না। তাদের বক্তব্য, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা তুলনায় অনেক পরে তাদের দেশে এসেছে। স্বভাবতই, সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তারা দেশের আর পাঁচজনের মতো নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী নয়। এমনকী
সম্প্রতি মিয়ানমারের বিদেশমন্ত্রী তথা শাসকদলের প্রধান আং সাং সু চি তাঁদের এই সমস্যাকে ভারতের কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি
মিয়ানমারের সংবাদপত্রগুলিতে মূলত সরকারের অবস্থানই প্রতিফলিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তারা আরসা বেঙ্গলি জঙ্গি বলে অভিহিত করছে। বেঙ্গলি বলতে এখানে অবশ্য বাঙালি নয়, বাংলাদেশিদেরই বোঝানো হচ্ছে। হাড়দহে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বেশিরভাগই বাংলায় কথা বলছেন।