প্রণব মুখোপাধ্যায় কী ভাবে আরএসএসকে খুশি রাখলেন
প্রাক্তন রষ্ট্রপতির নাগপুরের বক্তৃতা একটি বড় প্রহসন, তা শুধুই আরএসএসকে বৈধতা দিল
- Total Shares
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে আরএসএসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা নিশ্চিত করতেই গোটা দেশ জুড়েই বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর নিজের দলেও তাঁর এই আরএসএসের আমন্ত্রণ গ্রহণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছিল। বেশ কয়েকজন নেতানেত্রী জনসমক্ষে এই আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আবার, বেশ কয়েকজন নেতানেত্রী প্রণবকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রেখে বিক্ষুব্ধদের অনুষ্ঠান দিন অবধি ধৈর্য্য ধরবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আরএসএসের বয়স এখন নয় নয় করে একশো বছর। দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধের ফ্যাসিবাদীতে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা এবং এই সংগঠন খোলাখুলি অ্যাডলফ হিটলার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকে। স্বাধীনতার আগে ও স্বাধীনতার সময় থেকে আরএসএসের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পিছনে আরএসএসের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ, আরএসএস কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করতে দেশ জুড়ে বিভিন্ন দাঙ্গার জনক তাঁরা, এ ছাড়াও আরএসএস নাকি অসাম্প্রদায়িক হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের জন্য মরিয়া।
আরএসএস সর্বদাই আড়ালে আবডালে কাজ করতে পছন্দ করে এসেছে। কিন্তু তারা যে এই ভাবে তাদের সংগঠনকে প্রচারমাধ্যমের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে দেবে তা সত্যিই অকল্পনীয় ছিল। তারা কী ভাবে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক অনুষ্ঠানে নিজেদের ভাবাদর্শ নিয়ে বিরোধ করল? সব চেয়ে বড় কথা, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এমন কী দায় পড়েছে যে তিনি শতাব্দী প্রাচীন এই সংগঠনকে খামকা তিরস্কৃত করবেন?
আরএসএসের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই
সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কংগ্রেসের দ্বিচারিতা সকলেরই জানা। আর তাই, সেই দলের এক অন্ধ সমর্থক আরএসএসেকে আইনি স্বীকৃতি দিলেও তা কাউকেই অবাক করেনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারবর্গও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আরএসএস এই মুহূর্তে বেশ শক্তিশালী। হাজার হোক, এই সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি তো এখন দেশের শাসকের ভূমিকায়। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা যে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের এক জোট করতে চাইবে তা ভাবাটা বোধহয় খুব একটা অন্যায় হবে না।
দেশের প্রায় ১৮ কোটি মুসলমান বৃহস্পতিবার গোধূলি লগ্নে রমজানের উপোস ভেঙ্গে দেখল যে ভারতের এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে "ভারত মাতার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে" সম্বোধন করলেন। এই দৃশ্যে দেখে মুসলমানরা আতঙ্কিত না হলেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তো বটেই। তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন যে দেশের এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান দেশের গৌরবময় ইতিহাসের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে মাত্র দু'বারই 'মুসলমান' শব্দটি উচ্চারণ করলেন। সেই ইতিহাসে মোগলদের কোনও উল্লেখ নেই।
এর থেকেই পরিষ্কার যে যাদের আমন্ত্রণে তিনি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের কোনও মতেই চটাতে চাননি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
পরবর্তী ২০ মিনিট ধরে প্রণব মুখোপাধ্যায় দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের মুখ্য বিষয়গুলো নিয়ে বক্তৃতা করলেন। আর তাঁর দৌলতেই এই প্রথমবার আরএসএসের মতো একটি সংগঠনের সমাবর্তন অনুষ্ঠান গোটা দেশ জুড়ে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হল। এমনকি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মুখও প্রায় ৪০ মিনিট ধরে টেলিভিশন পর্দায় দেখানো হল যেখানে তিনি তাঁর সংগঠনের চিরাচরিত বক্তব্যগুলো পুনরায় তুলে ধরলেন। অনেকেই তর্ক করতে পারেন যে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতা শুধুমাত্র আরএসএসকে কেন্দ্র করেই ছিল। কিন্তু একটা বিষয় অস্বীকার করা যাবে না যে যখন দেশের সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত সেই সময় তিনি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কিছুটা হলেও দেশের জনজীবনের লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেছেন।
একজন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা যখন আরএসএসকে বৈধতা দিচ্ছেন তখন তার সুবিধা যে বিজেপিও ভোগ করবে না, এটা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? তাঁর বক্তৃতাও তো একেবারেই অন্তঃসার শূন্য ছিল।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কিছুটা হলেও দেশের জনজীবনের লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেছেন
এই ধরণের বক্তৃতা যে কোনও ধরণের অনুষ্ঠানে বা সরকারি স্কুলে বা কলেজে সর্বদাই শোনা যায়। প্রণব কি আরএসএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন যে আরএসএস বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের মতো সংগঠনগুলোকে দেশের সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করবার জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছে? প্রণব কি ভাগবতকে বলেছেন যে ভারতকে ক্রমাগত হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করবার জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে? তিনি কি প্রশ্ন তুলেছেন যে আরএসএস কোন গণতান্ত্রিক সংগঠন না হয়েও কী ভাবে নরেন্দ্র মোদী সরকারের মূল্যায়ন করে? অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই যখন গেরুয়া পতাকার সামনে মাথা নোয়ালেন তখন তাঁর কি একটি বারের জন্যও অনুশোচনা হয়নি? তিনি কি একবারের জন্যেও ভেবেছিলেন যে এই অনুষ্ঠানে কেন একটি ত্রিবর্ণ পতাকা ছিল না বা কেন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হল না? সব চেয়ে বড় বিষয়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কি দেশ জুড়ে চলা ঘৃণ্য রাজনীতি নিয়ে আরএসএসের ভূমিকা উপলব্ধি করতে পারলেন?
কংগ্রেস তাঁকে দু দু'বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার থেকে বঞ্চিত করেছিল বলেই কি প্রণব মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসের উপর ক্ষিপ্ত? আর, তাই কি আরএসএসের আমন্ত্রণ রক্ষা করে তিনি বুঝেই দিলেন যে তিনি এখনও রাজনীতি করতে পারেন? এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলবে। কিন্তু একটা বিষয় তিনি নিজেও অস্বীকার করতে পারবেন না। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তিনি আরএসএসকে ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোতের দিকে ঠেলে দিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় আমন্ত্রণ গ্রহণ সত্যি বেদনাদায়ক। আরএসএস নিয়ে তাঁর বক্তৃতা তো সব চেয়ে বড় প্রহসন। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যাবেলায় জিতল কে? এই প্রশ্নের উত্তরে জন্য কোনও পুরস্কার মূল্য নেই।
লেখাটা পড়ুন ইংরেজিতে