পেট্রল-ডিজেল মূল্য আকাশছোঁয়া: জেটলি সাহেব, আমাদের করের টাকা কোথায় গেল?

"যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সাহারা মরুভূমির দায়িত্বে থাকলে বালিও কম পড়বে।"

 |  4-minute read |   23-05-2018
  • Total Shares

নরেন্দ্র মোদীর "আচ্ছে দিন" স্লোগান তো এখন বহুল প্রচলিত। মোদীর ভাবাবেগকে সামান্য একটু বদলে দিয়ে দেখুন এই স্লোগানে কিন্তু বিশেষ কোনও ভুল নেই। বর্তমানে ডিজেল ও পেট্রোলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ ভুলতে পারছেন না যে ২০১৪ থেকে ২০১৮ অবধি অপোরিশোধিত তেলের দাম একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। গোটা বিশ্ব যখন সস্তার তেল উপভোগ করছিল তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর একের পর এক মোটা অঙ্কের কর চাপিয়ে গেলেন। জেটলি নাকি খারাপ সময়ের জন্য পয়সা জমিয়ে রাখছিলেন।

তেলের দাম আবার আকাশ ছুঁয়েছে। এই পরিস্থিতে অর্থমন্ত্রককে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে - মোটা অঙ্কের কর থেকে আদায় করা সঞ্চয় এখন কোথায় উবে গেল? এই পরিস্থিতিতে সরকার কি আমাদের সেই সঞ্চয়ের সাহায্যে রক্ষা করবে?

উত্তরটা খুঁজতে গেলে গত চার বছর ধরে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ঠিক কী ভাবে নয়-ছয় করা হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

১) ২০০৮ সালে অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময় প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ১৩২ ডলার। ২০১৪ সালের দ্বিতীয় ভাগে তেলের দাম কমতে কমতে প্রতি ব্যারেলে ৪৬ ডলারে এসে ঠেকে।

২) এর ফলে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি ভাবে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রন করা হবে না। জ্বালানি বিপণন সংস্থাগুলো প্রতিদিনের অপরিশোধিত তেলের দামের উপর ভিত্তি করে জ্বালানির দাম নির্ণয় করবে।

৩) ক্রেতারা আশা করে বসেছিলেন যে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার জন্য পেট্রল ও ডিজেলের দামও অনেকটা হ্রাস পাবে। কিন্তু ২০১৭ র আর্থিক বর্ষের মধ্যেই সরকার পেট্রোলের উপর ২১.৫ টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলের উপর ১৭.৩ টাকা প্রতি লিটার শুল্ক কর ধার্য করে ফেলে।

৪) এর ফলে, ২০১৭ সালের আর্থিক বর্ষে পেট্রোলিয়াম পণ্যের থেকে সংগৃহীত শুল্ক করের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১.৬ শতাংশ হয়ে যায়, যা ২০১৪ সালের আর্থিক বর্ষে মাত্র ০.৭ শতাংশ ছিল। শেষ কয়েক দশকে তেল থেকে প্রাপ্ত করের পরিমাণ হিসেবে করলে এটি একটি রেকর্ড।

উপার্জিত কর কী ভাবে ব্যবহার করা হল?

চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী পেট্রোলিয়াম পণ্য থেকে উপার্জন করা মোটা অঙ্কের করের এক বৃহৎ অংশ রাজ্যগুলোকে দেওয়া হয়েছিল। বাকিটা দিয়ে সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়।

অপরিশোধিত তেলের দাম কম থাকার সময় আরও দু'টি লাভ হয়। পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫.২ শতাংশ থেকে কমে ১,৮ শতাংশ হয় এবং খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৯.৪ শতাংশ থেকে কমে ৪.৫ শতাংশ হয়। একই সঙ্গে কম দামে আমদানি হওয়াতে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা লেনদেন ঘাটতি স্বস্তিদায়ক জায়গায় পৌঁছায়।

যখন তেলের বাজারে আগুন

১) পেট্রল ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব এবার অর্থনীতির উপরও পড়তে চলেছে। এবার চাপ পড়বে ভর্তুকি-মুক্ত এলপিজির উপর।

২) যে ভাবে জ্বালানির দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মূল্যবৃদ্ধির হারও শোচনীয় হয়ে উঠবে এবং ২০১৯ সালের আর্থিক বর্ষের আগেই এর প্রভাব চরমে পৌঁছাবে।

৩) চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা লেনদেন ঘাটতিও অনেকটা বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে ভারতীয় মুদ্রাস্ফীতির উপরেও।

body_052318015444.jpgমোটা অঙ্কের কর থেকে আদায় করা সঞ্চয় এখন কোথায় উবে গেল?

রক্ষা পাওয়ার সহজ উপায়

সরকার রাজকোষ ঘাটতির উপর ঝুঁকি না নিলে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অর্থমন্ত্রকের উচিৎ অবিলম্বে শুল্ক কর হ্রাস করে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। ধরে নেওয়া যাক অপরিশোধিত তেলের দাম ৬৫ ডলার প্রতি ব্যারেল এবং সরকার লিটার প্রতি দু'টাকা করে শুল্ক কর হ্রাস করল সে ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ থেকে প্রায় ০.১ থেকে ০.১২ শতাংশ মতো রাজকোষ ঘাটতি বাড়বে।

রাজ্যগুলোও পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর ভ্যাট কমিয়ে পেট্রল ডিজেলের দাম কিছুটা হ্রাস করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বিপুল অর্থ পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যগুলোর রাজকোষের অবস্থা যথেষ্ট করুণ। তাই তাদের পক্ষে এই জনদরদী সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটা সহজ হবে না।

সরকার পেট্রল-ডিজেল মূল্যকেও জিএসটির আওতায় আনবার যে পরিকল্পনা করছিল, তা এই অবস্থায় অসম্ভব।

অপ্রিয় সত্য

শেষ চার বছরে তেলের দাম সস্তা থাকার সুযোগ নিয়ে সরকার মোটা অঙ্কের কর চাপিয়েছে। কিন্তু এই কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেনি। গোটা বিশ্ব যখন সস্তায় জ্বালানি কিনছিল তখনও ভারতীয়রা মোটা টাকার বিনিময় জ্বালানি কিনতে বাধ্য হচ্ছিল এই ভরসায় যে খারাপ সময় তা কাজে আসবে।

শেষ চার বছর পেট্রোলিয়াম পণ্যের থেকে উৎপাদিত মোটা অঙ্কের কর যে ভাবে খরচ করা হয়েছে তার থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার - এই কর অন্য কারণেই সরকার জনগণের উপর আরোপ করেছিল। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে এই উৎপাদিত কর জনগণকে স্বস্তি দেবে - তা একেবারেই নয়।

সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন আর রাজ্যগুলোকে মোটা টাকার আর্থিক অনুদান জেটলির পক্ষে সম্ভব হত না যদি না তিনি সস্তার অপরিশোধিত তেলের উপর মোটা অঙ্কের শুল্ক কর তিনি আরোপ করতেন। সস্তার তেলের স্বর্ণযুগ শেষ। তার প্রভাব ইতিমধ্যেই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর পড়তে শুরু করে দিয়েছে।

আপনার বাড়ির নিকটবর্তী পেট্রল পাম্পে গিয়ে দেখুন মিল্টন ফ্রাইডম্যানের ভবিষ্যদ্বাণী হুবুহু মিলে যাচ্ছে : "কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে সাহারা মরুভূমির দায়িত্ব দিয়ে দেখুন, দেখবেন বালিও কম পড়েছে।"

লেখাটা পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ANSHUMAN TIWARI ANSHUMAN TIWARI @anshuman1tiwari

Editor, economic analyst, columnist, author

Comment