পশ্চিমবঙ্গে এনআরসির বার্তা অমিত শাহের, টাকা নিয়ে খোঁচা ‘ভাইপো’কে
কেন্দ্রের টাকা যাচ্ছে ‘ভাইপো’ ও সিন্ডিকেটের কাছে, তোপ অমিতের
- Total Shares
দরকারে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে। অসমে এনআরসির (নাগরিক পঞ্জীকরণ) চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ হওয়া মাত্রই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এনআরসি নিয়ে বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তারপরে পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রথম জনসভাতে সেই এনআরসি প্রসঙ্গই তুলে আনলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।
ক্ষুদিরাম বসুকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বক্তৃতা শুরু করেন অমিত শাহ (ডেইলিO বাংলা)
গত বিধানসভা ভোটের ফলাফলে যেখানে রাজ্যে চতুর্থ স্থানে ছিল বিজেপি, সেখানে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে, রাজ্যে এখন তৃণমূলের প্রধান বিরোধী হল বিজেপিই। জঙ্গলমহলে বিজেপি দারুণ ফল করায়, সভা করার জন্য মেদিনীপুরকে বেছে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এ বার রাজ্যে এসে ২০১৯ লোকসভা ভোট নয়, ২০২১ সালের ভোটের প্রচার করে গেলেন বিজেপির শীর্ষ নেতা। ভোটের মেরুকরণ করলেও, রাজ্যের মুসলমানদের বিরোধিতা করেননি অমিত শাহ।
নাগরিক পঞ্জীকরণ
অসমে নাগরিক পঞ্জীকরণ নিয়ে প্রথম থেকেই বিরোধিতা করে এসেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অসমে তৃণমূল প্রতিনিধি দলও পাঠিয়েছিলেন। অমিত শাহ তাই তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেছেন ২০০৫ সালে এ রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে লোকসভায় অধ্যক্ষের আসনের দিকে ভোটার তালিকা ছুড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ। এখন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরাই তাঁর ভোটব্যাঙ্ক, তাই দেশের নিরাপত্তার কথা না ভেবে, রাজ্যের মানুষের কথা না ভেবে তৃণমূলনেত্রী ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন অমিত শাহ।
বাংলাদেশ থেকে যে সব হিন্দু এ রাজ্যে এসেছেন, তাঁদেরও বরাভয় দিয়েছেন অমিত। নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল, ২০১৬ প্রসঙ্গ টেনে তিনি আগামী ২০১৯ সালের ভোটের আগে এ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে আহ্বান করেছেন কংগ্রেস ও তৃণমূলকে।
বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতিকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও অন্যরা (ছবি: সুবীর হালদার)
অসম অ্যাকর্ড নিয়ে তাঁর বক্তব্য, চাপের মুখে ভেঙে পড়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। আর আদালতের যে নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কার্যকর করতে পারেননি, সেই নির্দেশ কার্যকর করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একই সঙ্গে এ নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থানও স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছেন অমিত শাহ।
হিন্দু আবেগে নাড়া
উলুবেড়িয়ায় রথকমিটির জমিতে নির্মিত স্কুলে নবি দিবস পালন করার দাবিতে শেষ পর্যন্ত সরস্বতী পুজো বন্ধ হয়ে যায়। রাজ্যে বেশ কয়েকটি স্কুলে গত বছর সরস্বতী পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং অভিযোগ, কোনও ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি প্রশাসন।
স্মরণাতীত কাল ধরে চলে আসা বিজয়াদশমীতে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনও এ রাজ্যে বন্ধ হতে বসেছিল প্রশাসনের নির্দেশে, কারণ মহরম। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে দুর্গাপ্রতিমা ভাসান দেওয়া সম্ভব হয় বিজয়াদশমীতে। সেই প্রসঙ্গ তুলে অমিত শাহ বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে আবার স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পুজো চালু হবে, প্রতিমা নিরঞ্জন হবে আগের মতোই।
বাঙালি আবেগ
২৮ জুন রাজ্যে এসে বিড়লা সভাগারে বঙ্কিম স্মারক বক্তৃতা করেছিলেন অমিত শাহ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আদর্শগত দিক থেকে বিজেপি ও ভারত কী ভাবে বাংলার কাছে ঋণী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দেমাতরম্, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতা ছবির প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলেইছিলেন। এ দিন তিনি বাংলার মাটিকে কাজি নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করেন। যে সব মুসলমান দেশভাগের সময় ভারতে থেকে গিয়েছেন, তাঁদের যে উদ্বেগের কোনও কারণ নেই সে কথা বুঝিয়ে দেন অমিত শাহ।
বিজেপির জনসভায় কর্মী-সমর্থকরা (ছবি: সুবীর হালদার)
বক্তৃতা করার আগে এ দিন শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন অমিত শাহ। ১৯০৮ সালের ১১ জুন মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস বয়সে ফাঁসি হয় ক্ষুদিরাম বসুর। মৃত্যুর আগে তাঁর ইচ্ছা ছিল দেশের ছেলেদের বোমা বাঁধাটা শিখিয়ে যাওয়া। যদিও বিচারক তাঁর সেই আর্জি নাকচ করে দেন।
এ দিন অমিত শাহ ও বিজেপির মহিলা সভানেত্রী পুনম মহাজনের বক্তৃতায় উঠে এসেছে রাসবিহারী বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, রামকৃষ্ণ পরমহংস, শ্রীচৈতন্যদেবের প্রসঙ্গও।
তৃণমূলের সমস্যা
স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পুজো যে বন্ধ হয়েছে সে কথা তৃণমূল অস্বীকার করতে পারবে না। সরস্বতী পুজো করতে চেয়ে ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করলে পুলিশ লাঠি মেরে তুলে দেয় তাদের। আহত হয় ছাত্রীও। এখন অমিত শাহ সেই সরস্বতী পুজোর প্রসঙ্গ টেনে আনায় এ বার রামনবমীর মতো তৃণমূলকেও সরস্বতী পুজো করতে হতে পারে।
কট্টরপন্থীদের নিদান ছিল নবি উৎসব করতে দিতে হবে স্কুলে, তবেই হবে সরস্বতীপুজো। অনেক ক্ষেত্রে সে সব হয়েওছে। কিন্তু যে সব স্কুল মন্দিরকমিটির জমিতে, তাদের রাজি করানো যায়নি অন্য ধর্মের উৎসব পালনে। সে ক্ষেত্রে এ বার তৃণমূল কংগ্রেস কী অবস্থান নেয়, সেটা সময়ই বলবে। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের উভয়সঙ্কট। এই ধরনের এলাকায় ভোটের মেরু়করণ আরও তীব্র ভাবে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই সঙ্গে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের উৎসব হলে, তৃণমূল সরকার গুরুত্ব দিত ইসলাম ধর্মের উৎসবকে। সম্প্রতি তারা রামনবমী ও হনুমানজয়ন্তী পালন শুরু করলেও এ বার পুজোর সময় প্রশাসন কী নির্দেশ দেবে? শাসকদলের এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা।
ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি
অমিত শাহ জানেন যে তাঁদের প্রধান ভোটব্যাঙ্ক হল হিন্দুরা। তাই সরস্বতীপুজো ও বিসর্জন প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। আবার অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোট বড় ফ্যাক্টর, তাই নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ টেনেছেন তিনি। তিনি জেনে এসেছেন, এ রাজ্যে সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল। তাই এ রাজ্যে যাঁরা ঘুসপেটিয়া বা অনুপ্রবেশকারী নন, তাঁদের অভয় দিয়েছেন তিনি, খেয়াল রেখেছেন, যাতে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তাঁরা মুসলমান বিরোধী বলে পরিচিত না হয়ে যান।
তবে এই প্রথম নয়, বিজেপি ছোট রাজ্যের পক্ষে হলেও, কোনও দিনই গোর্খাল্যান্ডের দাবি মানা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়নি, যদিও ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে দার্জিলিংয়ে গিয়ে গোর্খাল্যান্ডের জয় বলে স্লোগান দিয়েছিলেন যশবন্ত সিং, তিনি বিপুল ভোটে জিতেওছিলেন।
বক্তৃতার আগে মঞ্চে অমিত শাহ (ছবি: সুবীর হালদার)
এনআরসি প্রসঙ্গ টেনে তিনি কংগ্রেস ও তৃণমূলকে একহাত নিয়ে বলেছেন, বিজেপি আগে দেশের নিরাপত্তার কথা ভাবে, ভোটব্যাঙ্কের কথা তার পরে। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী অসম অ্যাকর্ডে সই করলেও তাঁর ছেলে বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে এ প্রসঙ্গে নিরব রয়েছেন বলে কটাক্ষ করেছেন অমিত শাহ।
২০২১-এর প্রচার শুরু
যে রাজ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজত, রামপ্রসাদী গান বাজত, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কীর্তন বাজত সেই রাজ্যে এখন শুধু গুলি-বোমার শব্দ। রাজ্যে কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, তার বদলে এখন এ রাজ্যে বেআইনি অস্ত্র কারখানা হয়েছে। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের গণতন্ত্র হরণের কথাও তিনি বলেন।
এ রাজ্যেও নাগরিক পঞ্জীকরণের বার্তা দিলেন অমিত শাহ (ছবি: সুবীর হালদার)
রাজ্যের অবস্থা এখন কেমন? স্বাধীনতার পরে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে এ রাজ্যের অবদান ছিল ২৫%, কংগ্রেস জমানা যখন শেষ হল তখন তা কমে হয়েছ ১৩%। বাম জমানার শেষে তা ৪% এবং সাত বছরের তৃণমূল রাজত্বে তা আরও কমে হয়েছে ১%। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে অমিত শাহ বলেন, একবার বিজেপিকে সুযোগ দিতে।
ইউপিএ জমানায় ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য যেখানে ১,৩২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, সেখানে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে মোদী জমানায় পশ্চিমবঙ্গ পাচ্ছে ৩,৫৯,০০০ কোটি টাকা। সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে সেই প্রশ্ন তুলে উত্তরও দিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। নাম না করে তিনি 'ভাইপো' ও সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন।
জোট রাজনীতি নিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা বললেও, ২০১৯ সালের ভোট নিয়ে, জোট নিয়ে নয়, অমিত শাহ শুধুমাত্র এই রাজ্যকেই যে এখন তাঁর লক্ষ্য স্থির করেছেন, তা এদিনের বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন।