নমঃশূদ্ররা চিরকালই অবহেলিত, তাঁদের উন্নয়নের কথা ভোটে কতটা সুবিধা দেবে মমতাকে
উনিশ শতাব্দীতে নমঃশূদ্ররা লেখাপড়া শুরু করেন এক সাহেবের হাত ধরে, তাঁকে ভুলেছে বাঙালি
- Total Shares
বাংলার নবজাগরণ নিয়ে প্রচুর চর্চা হলেও সেটি ছিল আসলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নবজাগরণ। নিম্নবর্গীয়রা যে জায়গায় ছিলেন তাঁরা সেই জায়গাতেই রয়ে গেলেন। বহুবিবাহের চলও ছিল ব্রাহ্মণ-সহ উচ্চবর্ণের মধ্যে, তাঁদের সম্পত্তির লোভই সম্ভবত সতীদাহ প্রথা প্রচলনের মূল কারণ। তাই এই সব প্রথা বন্ধে কোনও লাভ হয়নি নিম্নবর্গীয়দের।
শিক্ষা ছাড়া যে তাঁদের উন্নতি সম্ভব নয়, সে কথা বুঝেছিলেন নমঃশূদ্র বলে পরিচিত দূরদর্শীরা, কিন্তু তাঁদের শিক্ষা পাওয়ার উপায় ছিল না বললেই চলে। সকলে শিক্ষিত হয়ে গেলে সেইসব কাজ কারা করবে? নিজেদের স্বার্থেই সযত্নে তাঁদের শিক্ষার আলো থেকে নিম্নবর্ণের মানুষজনকে দূরেই রেখেছিলেন উচ্চবর্ণের মানুষজন। তাঁদের জন্য পাঠশালা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ করা সে যুগে কোনও সমস্যাই ছিল না।
তাই এক অস্ট্রেলিয়ান মিশনারীর সাহায্যে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠ দিয়েই শুরু হল নমঃশূদ্রদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ। তাও লড়াই ও ধর্মঘটের পরে। সম্ভবত কাপালি, পৌণ্ড্র, মালো, মুচি, চণ্ডাল প্রভৃতি জাতের শিক্ষার খরচও এসেছিল তাঁর সৌজন্যেই। তবে ডেভিড হেয়ারের মতো বাঙালি মনে রাখেনি সেই অস্ট্রেলিয়ান সাহেবকে, যাঁর নাম সি এস মিড।
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পরিষেবা দেবে না বলে ১৮৭৩ সালের ৮ এপ্রিল (সম্ভবত ভারতে যনামে পরিচিত হন। মূলত তাঁদের বসবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার ঢাকা, বাখারগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, যশোহর ও খুলনা জেলায়। তাঁদের একসময় অস্পৃশ্য বলেও মানবতাবিরোধী কাজ করা হয়েছে।
তাঁদের শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার কথা ভাবেন হরিচাঁদ ঠাকুর
ফরিদপুর জেলার হরিচাঁদ ঠাকুরই প্রথম ভেবেছিলেন যে শিক্ষার মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষজনের সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ সেই ভাবনাকে সফল করতে পদক্ষেপ করেন। তাঁরাই এখন মতুয়াদের আরাধ্য। মতুয়া বলতে সেই নমঃশূদ্রদেরই বোঝায় যাঁরা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের ভক্ত। দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে তাঁরা এ দেশে আসেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বর্তমানে তিন কোটির কাছাকাছি নমঃশূদ্রের বসবাস। এঁদের বড় অংশই মতুয়া।
পঞ্জাব যতটা মসৃণ ভাবে বিভক্ত হয়েছিল বাংলা সে ভাবে বিভক্ত হয়নি। এখনও নিয়মিত ভাবে সীমান্ত পার করে অনেককে এ পারে আসতে হয় চাষাবাদের জন্য। কাঁটাতারের ওপারে থাকতে হয় অনেক ভারতীয়কেই। ১৫ অগস্ট দেশ ভাগ হলেও বাংলার ক্ষেত্রে অনেকেই তিন দিন পরে, মানে ১৮ অগস্ট জানতে পারেন যে তাঁদের বাড়ি কোন পারে পড়েছে।
দারিদ্রের কারণে সবেচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করে এ পারে এসেছেন তথাকথিত নীচু জাতের মানুষজন। কারণ তাঁদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল না বললেই চলে। এ দেশেও তাঁদের জন্য জায়গা ছিল না। দ্বিতীয়বার তাঁদের অনেককে ‘নির্বাসিত’ হতে হয় অন্য রাজ্যে। আর যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও যে খুব মর্যাদা পেয়েছেন তেমন নয়। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের পরে সিপিএমের জমি আচমকাই ধ্বসে যায়। তখন মতুয়াদের ভোট নিশ্চিত করার উপরে জোর দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০১১ সালের ভোটের আগে উত্তর ২৪ পরগনায় মতুয়াদের ‘বড়মা’র আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির কর্তাদের ভোটে দাঁড় করিয়ে জিতিয়েও আনেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে সিপিএমও বড়মার কাছে গিয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৪ সালের পরে মতুয়া-রাজনীতিতে বিজেপিও ঢোকে। ঠাকুরবাড়ির তৃণমূলপ্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজেদের দলের প্রতীকে তারা দাঁড় করায় ঠাকুরবাড়ির সদস্যকেই। ফলে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বিজেপির নতুন লক্ষ্য নয়। তার উপরে আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তর ২৪ পরগনায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সুবিধা পাওয়ার আশায় রয়েছে বিজেপি।
এ রাজ্যে নাগরিক পঞ্জীকরণ করা হবে বলে বিজেপির ঘোষণা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে বিজেপি যে ঘোষণা করেছে, তাতে তথাকথিত নীচু জাতের ভোট বিজেপির বাক্সে আসার সম্ভাবনা আরও বাড়ছিল।
যুগে যুগে নমঃশূদ্ররা যে বঞ্চিত হয়েই এসেছেন সে কথা প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখে না, এটা ধ্রুবসত্য। একই ভাবে দেশের রাজনীতিতে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটেক কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দলই গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সাড়ে তিন বছর কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই রাজনৈতিক দলগুলি বুঝে যায়, হিন্দুভোটও দরকার। তাই হঠাৎ শিবভক্ত হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং হিন্দু ভোটের কথা ভাবতে শুরু করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুসলমান ভোট যে তারা বিশেষ পাবে না সে কথা সবচেয়ে ভালো জানে বিজেপি। তাই এ রাজ্যে নাগরিক পঞ্জীকরণের কথা বললে মুসলমান ভোট হারানোর কোনও আশঙ্কা তাদের নেই, যদিও হিন্দুদের একাংশের ভোট তারা পেতে পারে। সেই ভোট কেটে নিজের দিকে টানতেই নমঃশূদ্র ভোটব্যাঙ্কের দিকে নজর দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসন্ন নির্বাচনের আগে হিন্দু ভোটের একাংশ নিশ্চিত করতে বিশাল সিদ্ধান্ত তিনি ঘোষণা করতে চলেছেন। উত্তরবঙ্গে গিয়ে নমঃশূদ্রদের সেই আশ্বাস তিনি দিয়েছেন।
নমঃশূদ্রদের জন্য পৃথক উন্নয়ন পরিষদ গড়লে রাজনৈতিক লাভ হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বিজেপি যখন আদিবাসী ভোট অনেকটাই নিজের দিকে টানতে পেরেছে তখন রাজ্যে বসবাসকারী তিন কোটির কাছাকাছি নমঃশূদ্রকে নিজের দিকে টানতে, তাঁদের উন্নয়নে বোর্ড গঠনের ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে কথা দিয়েছেন। কোনও কিছু করুন বা না করুন ভোটের কয়েকমাস আগে তাঁদের উন্নয়নের জন্য একটি বোর্ড গড়ে দিতে পারলেই রাজনৈতিক ভাবে অনেকটা লাভ হবে।
শুধু নমঃশূদ্র কেন, প্রত্যেক নাগরিক যদি রাষ্ট্রের থেকে তাঁর প্রাপ্য পান, তা হলে বিকাশ অবশ্যম্ভাবী। প্রতিটি নাগরিকের উন্নতি মানে রাজ্য তথা দেশ আরও এগোতে থাকবে। তবে সেই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যদি ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি হয় তা হলে তো তা বেশ চিন্তারই। পিছিয়ে পড়া মানুষজনের উন্নতি ও ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে কোনও কিছু করার মধ্যে ফারাক আছে।
ভারতের অন্য বহু রাজ্যে জাতপাতের রাজনীতি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে তা ছিল না। কিন্তু এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যকলাপ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলমানদের তোষণের অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা এবং তাকেই সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিজেপির ভোট মেরুকরণের রাজনীতি থেকে এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে, যখন দেশের অন্য রাজ্যগুলো ধীরে ধীরে জাতপাতের রাজনীতি বার হওয়ার চেষ্টা করছে এবং প্রচারের মূল কথা হচ্ছে উন্নয়ন, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ কি ক্রমেই (বাস কন্ডাক্টরদের ভাষায়) পিছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?