এই প্রথম সত্যিই কোনও ঘটনা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ জুটিকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে
কৈরানার ফলে স্পষ্ট ২০১৯-এ জোটবদ্ধ বিরোধীদের বিরুদ্ধে জোটসঙ্গী হারানো বিজেপির কঠিন পরীক্ষা
- Total Shares
দেশের ১৫টি উপনির্বাচনের ফল বিজেপিকে একটিই সতর্কবার্তা দিচ্ছে: হাওয়া ঘুরছে। বিরোধীদের কাছেও বার্তাটি স্পষ্ট: জয়ী হতে গেলে জোট বাঁধতে হবে।
দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কৈরানায় বিরোধী সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্রীয় লোকদল প্রার্থীর জয় বিশেষ ভাবে চিন্তায় ফেলবে বিজেপিকে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্র থেকে তারা বেশ ভালো ব্যবধানেই জয়ী হয়েছিল। সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত দু’টি ব্যাপারে বদল হয়েছে। প্রথমত ২০১৪ সালে মোদী-ঝড়: উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৭১টি আসনে জয়ী হয় বিজেপি, জোটসঙ্গী ধরলে সব মিলিয়ে তারা জয়ী হয়েছিল ৭৩টি আসনে। চার বছরে সেই ঝড় থেমেছে, তার বদলে এখন শুধুই হতাশা ও বিরক্তি।
দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে ভোট বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার ফলে কৈরানা-সহ সমগ্র উত্তর প্রদেশে বিজেপি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল। কৈরানা উপনির্বাচনে সব বিরোধী গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে অভিন্ন শক্তি হিসাবে নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিরোধী শক্তিগুলি কি এই ঐক্য বজায় রাখতে পারবে? যে সব রাজ্যে বহুদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যেত, সেখানে অবশ্যই এই তত্ত্ব কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু যেখানে মূলত দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেখানে এ বার এই তত্ত্ব কার্যকরী নাও হতে পারে।
উপ-নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারে বিজেপি এখন দ্রুত অজুহাত দেওয়ার পন্থা থেকে সরে গিয়ে আত্মসমীক্ষার কথা বলছে। স্থানীয় রাজনৈতিক জোটসঙ্গীর থেকে ভেঙে বেরিয়ে আলাদা ভাবে লড়াই করেও যে জয়ী হওয়া যায়, মহারাষ্ট্রের পালঘরে শিবসেনাকে পরাজিত করাকে তারই উদাহরণ হিসাবে বিজেপি তুলে ধরতে পারবে। তবে জোটসঙ্গীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটাকেই গত চার বছরের হিসাবে বিজেপির সবচেয়ে বড় পরাজয় হিসাবেও ভাবা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সম্ভবত খুব খারাপ, হয়ত মারাত্মক ভুলটি করে ফেলেছেন জোটসঙ্গীদের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করার ক্ষেত্রে। এনডিএ-র জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার বদলে বিজেপি তাদের ধর্তব্যের বাইরেই রেখে গিয়েছে। তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) চন্দ্রবাবু নায়ড়ু যখন অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ মর্যাদা দাবি করেন তখন তাঁকে কোনও পাত্তাই দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি বারে বারে দেখা করতে চেয়েছেন তা সত্ত্বেও তিনি দেখাই করতে পারেননি। তিনি ফোন করলেও কোনও জবাব পাননি। শেষ পর্যন্ত যখন চন্দ্রবাবু নায়ড়ুর সঙ্গে মোদী দেখা করলেন, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে,আর কিছু করার নেই। জোট ভেঙে তেলুগু দেশম পার্টির বেরিয়ে যাওয়া শুধু যে লোকসভা ও রাজ্যসভায় সরকারের আসন সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে তা নয়, নানা অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে এবার এনডিএ শরিকরাও আরও জোরালো ভাবে গলা তুলতে করে দিল।
রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) এবং শিরোমণি অকালি দলের (এসএডি) মতো ছোট জোটসঙ্গীরাও মৃদু ভাবে বিজেপির অবজ্ঞার কথা বলতে শুরু করে দিল। খুব কম সময়ই বিভিন্ন নীতি, অর্থনীতি ও নির্বাচনী কৌশল নিয়ে তাদের সঙ্গে কদাচিৎ আলোচনা হয়েছে।
শিবসেনার সঙ্গে সমস্যার কারণ অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। উদ্ধব ঠাকরে তাঁর বাবা প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের মতোই কোনও দিন কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি এবং তাঁর চরিত্রগত বহু দোষও রয়েছে। ভুল শোধরানোর জন্য এই ক’বছরে অমিত শাহ তাঁকে খুবই কম সময় দিয়েছেন। বালাসাহেব ঠাকরে যখন বেঁচে ছিলেন, প্রয়াত প্রমোদ মহাজন যখনই মুম্বইয়ে যেতেন, তখনই তাঁর বাসভবন মাতশ্রীতে গিয়ে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে আসতেন। অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদী উদ্ধবকে এড়িয়ে গেছেন। আরও বড় কথা হল, শিবসেনা মনে করে, মহারাষ্ট্রে বিজেপির হিন্দুত্ব নীতি অনেকটাই শিথিল। তাই জোটের বড় সঙ্গীকে তারা নিয়মিত ভাবেই আক্রমণ করে। তবে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের এনডিএ সরকার বা মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফড়ণবীশ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত।
কেন্দ্রীয় পরিবহণ ও জাহাজমন্ত্রী নীতিন গড়করি সম্প্রতি বলেছেন, বিজেপি-শিবসেনা জোট হল অসুখী দাম্পত্যের মতো, তারা না পারে একে অপরের সঙ্গে থাকতে, না পারে একে অপরকে ছেড়ে দিতে। তবে বিজেপি বিলক্ষণ জানে যে সাধারণত এমন ক্ষেত্রে বিচ্ছেদই হয়ে থাকে।
নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল (জেডিইউ) এই ধরনের আরেকটা জোটসঙ্গী, যেখানে জোটের বন্ধনটা খুবই আলগা। জোকিহাটে উপনির্বাচনে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) কাছে জেডিইউ-র পরাজয়ে পর এখন নীতীশ কুমারের সামনে খুব কম উপায়ই রয়েছে। আরজেডি তাঁকে আর জোটসঙ্গী হিসাবে চাইছে না, তিনি যাই হোন না কেন বিজেপিও তাঁকে স্থানীয় নেতার বাইরে বেশি কিছু ভাবছে না, তাই এটাই এখন তাঁর কাছে মূল্যবান জোট।
নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের জোটসঙ্গীদের অবহেলা করার পাশাপাশি বিজেপির জনপ্রিয়তা হারানোর আরেকটি কারণ হল অর্থমন্ত্রকে অব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী হিসাবে অরুণ জেটলিকে বেছে নেওয়া খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত।
তাঁর পাঁচটি মধ্যমানের আর্থিক বাজেটে (২০১৪ সালের অন্তর্বর্তী বাজেট ধরে) অরুণ জেটলি মধ্যবিত্তদের (যাঁদের উপরে বিজেপি অনেকটাই নির্ভরশীল) হতাশ করেছেন। জিএসটি-কে অকারণ জটিল করে ব্যবসায়ীদেরও (বিজেপির ভরসার আরেক জায়গা) দূরে সরিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। কর তল্লাশি (ট্যাক্স রেড) করিয়ে এবং কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর বোর্ড (সিবিডিটি) যে আইনকে অস্ত্র করছে (যাকে কর সন্ত্রাস বা ট্যাক্স টেররিজম বলা হচ্ছে) তা করে তিনি শিল্পপতিদেরও (যাদের থেকে বিজেপি মোটা অঙ্কের অনুদান পায়) চটিয়ে দিতে পেরেছেন।
অর্থমন্ত্রকের আমলাতন্ত্র বাস্তবতা থেকে যে কতটা বিচ্ছিন্ন তার সর্বশেষ প্রমাণ হল জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। রাজ্যের বাবুরা নির্দেশের কদাচিৎ অন্যথা করতেন না বলে গুজরাটের মতো রাজ্যে মোদীর সময়ে আমলাতন্ত্রের উপরে ভরসা রাখা যেত। দিল্লিতে পুরোনো বিশ্বাসভাজনরা অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনতন্ত্রের অংশ। তাঁরা হয় সরকারি পরিকল্পনা রূপায়ণে বিলম্ব করেন নতুবা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িতই করেন না।
সেনা ছাউনি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সংক্রান্ত্র সাম্প্রতিক যে নির্দেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দিয়েছে তাতেও আমলাতন্ত্রের মারণ-প্রভাব একই ভাবে দেখা গেছে। এর ফলে সেনাকর্মীদের পরিবার অর্থাৎ তাঁদের স্ত্রী-সন্তানরা সন্ত্রাসবাদী হামলার লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারেন। শুধু তাই নয়, মোদীর পাকিস্তান নীতিও অসঙ্গত -- বার বার পাক মদতপুষ্ট হামলার পরেও পাকিস্তানকে সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (মোস্ট ফেভার্ড নেশন) তকমা দেওয়া হয়েছে এবং ওয়াগা সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য অব্যাহত রাখা হয়েছে।
মোদীর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, একই ভাবে প্রশ্ন রয়েছে আর্থিক সংযুক্তিকরণ, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় সংস্কার ও গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের জন্য উদ্ভাবনী প্রকল্প নিয়ে। মাথামুণ্ডহীন প্রতিরক্ষা বাজেট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে স্বল্প ব্যয় হল উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা। নির্ভয়া প্রকল্পেরর টাকা এখনও খরচই হয়নি। চার বছরেরও লোকপাল হয়নি। মুখ্য তথ্য কমিশনার (সিআইসি) পদ শূন্য থাকাও বাস্তবে তথ্যের অধিকার আইনকে বুড়োআঙুল দেখিয়েছে।
এর কোনওটাই ছোট সরকার, যথাযথ প্রশাসন নীতির উদাহরণ নয়। উপনির্বাচনের, বিশেষ করে কৈরানায় উপনির্বাচনের ফল বুঝিয়ে দিচ্ছে, ২০১৯ সালে জোটবদ্ধ বিরোধীদের বিরুদ্ধে ক্রমেই জোটসঙ্গী হারাতে থাকা বিজেপিকে কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন