বাংলার সংস্কৃতিই তাদের পাথেয়, প্রমাণে মরিয়া বিজেপি
বিজেপি প্রমাণ করতে চায়, আদর্শ ও সংস্কৃতির বিচারে তারা বাংলার অনেক কাছের
- Total Shares
যস্মিন দেশে যদাচারঃ। দলের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে গত সপ্তাহে অমিত শাহ যখন এ রাজ্যে দু’দিনের সফরে এলেন, তখন তিনি এই প্রবাদবাক্যটিই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চললেন।
যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশকে জাতীয়সঙ্গীত ‘বন্দেমাতরম্’ উপহার দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো সংস্কৃতিময় রাজ্যে এসে সেই রাজ্যের মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের চেয়ে ভালো উপায় আর কী-ই বা হতে পারে?
বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে মনোজ্ঞ বক্তৃতা করে বাঙালি বিদ্বজ্জনদের মন জয় করতে চেয়েছেন অমিত শাহ। বাঙালির মনে বাংলা ও বাংলা সাহিত্য জাগরুক করতে তিনি বর্ণনা করলেন কী ভাবে মাতৃবন্দনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, কী ভাবে তিনি মাতৃরূপ রচনা করলেন কাব্যের মাধ্যমে।
ঘটনাচক্রে যে ভারতমাতার মূর্তি তাঁর মঞ্চের পিছনে ছিল, তাও আরেক বাঙালির সৃষ্টি। কালজয়ী এই ছবিটি যিনি এঁকেছিলেন তিনি আর কেউ নন, শিল্পী-লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতমাতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বোঝাতে চাইলেন, বিজেপিকে উত্তর ভারতের, মূলত হিন্দিভাষী অঞ্চলের দল হিসাবে ধরা হলেও, আসলে তারা তাদের আদর্শ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিচারে বাংলার অনেক কাছের, বাংলার কাছে ঋণী।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়াও দল হিসাবে বিজেপি যাঁদের আদর্শ মেনে চলে, যাঁদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে এই বাংলার মহান সন্তান, সে কথাই প্রমাণ করতে চাইছে বিজেপি।
বাংলার মহান সন্তানরাই তাদের আদর্শ, প্রমাণে মরিয়া বিজেপি
গত এক বছরে বিজেপি উদযাপন করেছে রবীন্দ্রজয়ন্তী, নেতাজির জন্মদিন ও বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। পালন করেছে রথযাত্রা, সরস্বতী পুজো, দুর্গাপুজো ও কালীপুজো। দলের নির্দেশ হল, বাঙালির উৎসবগুলো তারা যেন সর্বতো ভাবে পালন করে এবং এই সব উৎসবগুলোকে যেন জনসংযোগের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে। দলটি যে শুধুমাত্র হিন্দি ভাষাভাষীদের সংগঠন নয়, বাঙালির আবেগ কাজে লাগিয়ে সেই ধারণা নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি।
এ রাজ্যের লোকের ধারণা, বিজেপি মানে প্রথমসারির শিল্পপতি, বনিয়া না হয় যারা পানমশলা খায় আর রাস্তাময় পানের পিক ফেলে। জিডি বিড়লা সভাগারের শ্রোতার আসনে বসা এক বিদ্বজ্জনের কথায়, “একবার অন্তত বাঙালির একান্ত নিজস্ব রজনীগন্ধা ও জুঁইফুলের গন্ধ পাওয়া গেল এই দলটি থেকে।” তিনি অবশ্য কোনও ভাবেই নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
বাংলার নাড়ির স্পন্দন বুঝতে গেলে সার্বিক ভাবে বাংলাকে বোঝা এবং মনেপ্রাণে বাঙালি হওয়া দরকার। অমিত শাহও চাইছেন, তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা এই কাজটিই করুন।
বিশ্বভারতীতে নরেন্দ্র মোদীও তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বাংলা দিয়েই। কথার মাঝে দু’একটা বাংলা শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করছেন অমিত শাহও। উচ্চারণ বাঙালিদের মতো হচ্ছে না বটে, তবে বাঙালি বাবু হয়ে ওঠার চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছেন না তাঁরা।
তারাপীঠে পুজো দিতে যাচ্ছেন বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ
২০১৯ সালের ভোটে বিজেপির স্লোগান হচ্ছে “এবার বাংলা” আর এই স্লোগানের উপরে দাঁড়িয়েই এখন সব পরিকল্পনা করছে বিজেপি।
বাঙালি হৃদয়ের কাছে থাকা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিল আরএসএস। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাপের একজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আরএসএস যে শুধু তাদের সমাবর্তনকে প্রচারের শিখরে নিয়ে গিয়েছিল, তাই নয়, এটাও দেখিয়ে দিয়েছিল যে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তির কাছেও তারা অচ্ছুৎ নয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনায় রাজ্যের সংস্কৃতিমহলের বড় অংশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিজেপি। আমন্ত্রিত হয়েছিলেন লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী, গায়ক প্রমুখ। তবে চেনা মুখের মধ্যে বুদ্ধদেব গুহ ছাড়া আর কেউ উপস্থিত হননি। এমনও হতে পারে যে তাঁরা ভেবেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে অমিত শাহ আর কী বলতে পারেন! আরও বড় কথা হল, তাঁরা গেরুয়াপার্টির কাছের লোক বলে তকমা সেঁটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
সকলে অবশ্য এখন একটা কথা মানছেন, আগামী নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্য বাংলা, আর সে জন্য বিজেপি এখন সর্বশক্তি দিয়ে বাংলার মানুষের মন জয় করতে চাইছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে