মহিলা হত্যাকারী: ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের গল্প
[বই থেকে উদ্ধৃত] কেম্পম্মা, ওরফে, সায়ানাইড মল্লিকা লোভ ও পার্থিব ভোগের জন্যে অপরাধী হয়েছিলেন
- Total Shares
মহিলাদের সব সময় শুশ্রূষাকারী বা প্রতিপালক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।কেউ কল্পনাও করতে পারেন না যে তারাও ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারেন। মানুষের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে খুন যেন শুধুমাত্র পুরুষরা করে।কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী আছে, মহিলারাও পুরুষদের মতো নির্মম ভাবে খুন করতে পারেন।
তবে জীবনের আর পাঁচটা দৃষ্টিভঙ্গির মতো, এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্ করা গেছে যে পুরুষদের খুনি হয়ে ওঠা থেকে মহিলাদের খুনি হয়ে ওঠার কারণগুলো অনেকটাই ভিন্ন। পুরুষরা মূলত লালসা, যৌন্যপীড়নের মানসিকতা বা হিংস্র মনোভাবের জন্যে খুন করে।উল্টোদিকে, মহিলারা প্রধাণত আর্থিক কারণে খুন করে থাকেন।খুন করবার দুটি উদ্দেশ্য অবশ্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে লক্ষ করা যায় - লোভ ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা।
ইতিহাসে এমন বহু হত্যা লক্ষ করা গেছে যেখানে মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনি যে একজন মহিলাও - যাকে মাতৃরূপে কিংবা ভগিনী বা স্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হয় - এই রকম একটা নির্মম অপরাধী হতে পারেন। আসলে, লিঙ্গের সাথে অপরাধের কোনো সম্পর্ক নেই।এবং, এটাই ধ্রুব সত্য।
বিভিন্ন হত্যার তথ্য পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে যে মহিলারা হয় তাঁদের কাছের মানুষকে খুন করেন, না হলে, প্রথমে একজনের কাছের লোক হয়ে উঠে তারপর তাকে খুন করে। মহিলারা বুদ্ধি খাটিয়ে হত্যার পরিকল্পনা এমন ভাবে করে যাতে তারা অতি সহজেই সাজা কমিয়ে ফেলতে পারে।
ট্রায়াল অফ ট্রুথ: ইন্ডিয়াস ল্যান্ডমার্ক ক্রিমিনাল কেসেস [ছবি: পেঙ্গুইন রান্ডম হাউস]
সায়ানাইড মল্লিকা
সিরিয়াল কিলারদের খোঁজ করতে বসলে আমরা কোনও ভাবেই লোভের উদেশ্যে খুনের কথা উপেক্ষা করতে পারিনা। কেডি কেম্পাম্মাকে দেশের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার হিসেবে মনে করা হয়। তার খুনের প্রধান উদেশ্য কিন্তু লোভ ও পার্থিব সুখ।
কেম্পম্মা যখন ৪৫ বছর বয়েসে গ্রেপ্তার হন তখন তাকে সায়ানাইড মল্লিকা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল কারণ তিনি ব্যাঙ্গালোর ও তার আশেপাশে প্রচুর লোককে সায়ানাইড খাইয়ে করিয়ে হত্যা করেছিলেন।
মল্লিকার মূল শিকার ছিলেন মহিলারা যাঁরা মনের শান্তির জন্য শহরের মন্দিরে মন্দিরে যেতেন। এই মহিলারা ধার্মিক ছিলেন। তবে সাংসারিক ছিল, অনেকেই ছিলেন নিঃসন্তান। সমস্যা মেটাতে তাঁরা ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতেন। মল্লিকা তাদের কাছে দাবি করতেন যে তিনি বিশেষ ধরণের আরাধনায় পারদর্শী এবং তিনি তাদের সমস্যা দূর করে দিতে পারেন।
এই ভাবে মহিলাদের বিশ্বাস অর্জন করে নেওয়ার পর সেই বিশেষ ধরণের পুজো-অর্চনার জন্যে মল্লিকা মহিলাদের কাছ থেকে দামি পোশাক ও গয়না চাইতেন। এর পর মহিলাদেরকে মন্দির চত্বরের কোনও গোপন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হত। পুজো শুরুর পরেই মল্লিকা মহিলাদের চোখ বন্ধ করবার নির্দেশ দিতেন এবং তাঁদেরকে সায়ানাইদের গুঁড়ো মিশ্রিত খাবার বা পানীয় খাইয়ে দিতেন। প্রায় ৯ বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরের মন্দিরগুলোতে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছিলেন মল্লিকা।
মল্লিকা যখন শেষপর্যন্ত একটি বাস স্ট্যান্ডের সামনে ধরা পড়েন তখন তাঁর কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ নগদ ও গয়না উদ্ধার করা হয়। এরপর জেরা চলাকালীন তিনি তার অপরাধ কবুল করে নেন।
সায়ানাইড মল্লিকা [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
সায়ানাইড মল্লিকা কিন্তু এখনও রহস্যই রয়ে গেছেন। কোনও নির্মম ব্যক্তিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আমরা প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি যে তাঁর অতীত জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল কিনা যা তাকে নির্মম হয়ে উঠতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু মল্লিকার অতীত সম্পর্কে আমরা খুব একটা ওয়াকিবহাল নই। তবে খুনের ধরণ একটা বিষয় আন্দাজ করাই যায় যে মল্লিকা এই খুনগুলো দামি গয়না বা পোশাকের লোভেই করেছিলেন। মল্লিকা মামলার শুনানির সময় পুলিশের তরফ থেকেও জানান হয়েছিল যে মূলত চুরির উদ্দেশ্যেই এই খুনগুলো করা হয়েছিল।মল্লিকা কোনও মানসিক অস্থিরতার ব্যাধিতে ভুগছিলেন না।
তরুণ বয়েসে মল্লিকা একজন দর্জিকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু এই সাধারণ জীবনযাপনের জন্যে তাঁর জন্ম হয়নি বলে মনে করতেন মল্লিকা। তিনি নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি আরও স্বচ্ছল জীবনযাপনের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। লোভ যদিও প্রধাণ কারণ, মল্লিকার সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার বীজ নিঃসন্দেহে জীবনের শুরুতেই বোনা হয়েছিল।
এই হত্যালীলা শুরু করবার আগে মল্লিকা একটি ছোট মাপের বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা চালাতেন। এরপর তিনি তার পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে এসে কখনও পরিচারিকা আবার কখনও স্যাকরার সহকারী হিসেবে কম মাইনের কাজ করতে থাকেন। খুব সম্ভবত এই সময়ই মল্লিকা বুঝতে পারেন যে অপরাধ জগৎই দ্রুত বিপুল ধন অর্জনের একমাত্র অবলম্বন। তার আর্থিক অবস্থা তার অপরাধী হয়ে ওঠার একটি কারণ হতে পারে।
মল্লিকাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের সময় বেশি লাগার কারণ পুলিশও কল্পনা করতে পারেনি যে ব্যাঙ্গালোরের মন্দিরে মন্দিরে ঘটতে থাকা রহস্য মৃত্যুগুলির পিছনে সহজ-সরল দেখতে একজন বছর পঁয়তাল্লিশের মহিলার হাত থাকতে পারে।
যারা মনে করেন মহিলারা শুধুমাত্র বাধ্য হয়ে বা আত্মরক্ষার জন্যে কোনও অপরাধ করেন তাদের কাছে মল্লিকা মামলা নিঃসন্দেহে শিক্ষণীয়। একজন মহিলা সত্যি সত্যি খুনি হয়ে উঠতে পারেন বলে আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনা। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমাদের অন্য ভাবে ভাবতে শেখায়।
[পিঙ্কি আনন্দ ও গৌরী গোবুর্ধনের লেখা ট্রায়ালস অফ ট্রুথ: ইন্ডিয়াস ল্যান্ডমার্ক ক্রিমিনাল কেসেস বইটি থেকে প্রকাশক পেঙ্গুইন রান্ডম হাউস-এর অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃত]