মুরগির ডিম ও মাংস আপনার শরীরের কোনও ক্ষতি করছে না তো?
গবেষণায় প্রকাশ, এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া
- Total Shares
এ যুগে মাংস বা ডিম খাওয়াটা ঠিক কতটা নিরাপদ? এতে এখন প্রোটিনের মতো পুষ্টিগু অনেক কমে গেছে, এবং অনেক বেশি পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক আছে। অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে দরকার ছাড়া গেলে তা ক্ষতিকর হতে পারে।
পোলট্রির নধর মুরগির মাংস বা শূকরের রসালো মাংস কিংবা বেকন ও বড় মাপের ডিম খাওয়ার সময় আমাদের অনেকেরই হয়ত সন্দেহ হয় কিন্তু তও বেশ রান্না করে মজা করে খাই। কিন্তু গবেষণায় যা উঠে এসেছে তা এবার কপালে ভাঁজ ফেলে দেবে।
২০১৭ সালে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সপেকটিভস নিয়ে তাদের যে রচনাটি বেরিয়েছিল সেখানে সেন্টার ফর ডিসিজ ডায়নামিক্স, ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসি (সিডিডিইপি)- একটি গবেষণার কথা লেখা হয়, আমি ওই লেখাটি পড়ি।
পঞ্জাবের কয়েকটা ফার্মে গবেষণা করা হয়, তাতে দেখা যায় যে ওখানকার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক রেসজসট্য়ান্ট ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। এই মুরগির মাংস ও ডিম খাবার ফলে আমাদের শরীরে এমন কয়েকটা অদরকারি অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে পড়ছে যেগুলো দরকারি অ্যান্টিবায়োটিককে কাজ করতে দিচ্ছে না। এই মুরগির মাংস ও ডিম মানুষের খাওয়ার জন্য। ফার্মের মুরগির মাংস ও ডিম থেকে যে পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে সেটা খুব ভয়ের। আর ওখানকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ফার্মের মুরগির মাংসের পরিমাণ ও ডিমের মাপ যাতে বাড়ানো যায় সে জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়।
ফার্মের মুরগির মাংস ও ডিমের মধ্যে এমনই অনেক অদরকারি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে যা দরকারি আন্টিবায়োটিককে (রেসজসট্যন্ট) কাজ করতে দেয় না। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় উনচল্লিশ শতাংশ সিপরোফ্লোকসাসিন (ciprofloxacin) পাওয়া যায় যা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ সারাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে ৮৬ শতাংশ নালিডিকসিক অ্যাসিড (nalidixic acid) এই আন্টিন্টিবায়োটিকটি মূত্রনালীর সংক্রমণ সারাতে সাহায্য করে।
ফার্মগুলিতে মুরগির মাংসের পরিমাণ ও ডিমের মাপ বাড়ানোর জন্য ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছে এই গবেষণার পরে। গবেষণার পর আর একবার বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল যে. যে সব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ নানা রোগ সারাবার জন্য মানুষের শরীরে ব্যবহার করা হয়, সেই একই অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যবহার করে খামারগুলোতে সুঠাম মুরগির মাংস, গরু-মোষ ও শূকর তৈরি করা হচ্ছে। কানের কোনও সংক্রামিত রোগ থেকে শুরু করে যক্ষ্মা -- বহু রোগই সারানো হয় এই সব ওষুধ দিয়ে। আমরা কিছু না জেনেই অবলীলাক্রমে খেয়েও চলেছি। শুধু মাত্র পঞ্জাবেই নয়, দেশের প্রায় সমস্ত খামারে এ ভাবেই চলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
খাবারে আন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
তাহলে এমনটা কেন হচ্ছে?
মাংস ও প্রাণীজ খাবারের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ও বাজারে কম দামে সো সব সরবরাহ করতে গিয়ে খামারগুলো এই ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। খামারের মালিক আবার তাঁদের লাভটা বজায় রাখতে গিয়ে মাংসের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করছেন এই ধরণের ওষুধপত্র। এর ফলে আমরা যে মাংস ও ডিম খাচ্ছি তাতে কোনও উপকার তো হচ্ছেই না, বরং ক্ষতিই হচ্ছে।
এমন কী ক্ষতি এতে?
সস্তা দামে মাংস ও ডিম খেতে হলে তার মূল্য তো চোকাতে হবেই, এমনটাই জানিয়েছে সিডিডিইপির অধিকর্তা রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ। তিনি বলেছেন, "পশু খামারগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাছাড়া ব্যবহার অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেও রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে আসছে।” ওঁর এই আশঙ্কাটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
পশুপাখির মধ্যে যদি বেশি পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় তা হলে তার থেকে এক ধরণের ব্যাক্টিরিয়ার (superbugs) জন্ম হয়। এই ব্যাক্টিরিয়ার থেকে যে সব রোগ হয়, সেগুলোকে সারানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আমরা আমাদের দোষেই একটা অ্যান্টিবায়োটিক-রেসজসট্যন্ট হয়ে পড়ছি।
যখন কোন পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয় তখন তার চারপাশে অন্যান্য যে ব্যাকটেরিয়া থাকে, সেগুলো এই অ্যান্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য অনেক এমন ব্যাকটেরিয়াও আছে যেগুলোকে ওষুধ নষ্ট করতে পারে না। যে ব্যাকটেরিয়াগুলো বেঁচে থাকে সেগুলোই পরে সুপারবাগ তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারপরেই এই সুপারবাগ মাংস ও অন্য প্রাণীজ খাবারের মাধ্যমে সোজা পৌঁছে যায় আমাদের শরীরে।
১৯৪০ থেকে উৎপাদনের জন্য মাংসে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুরু হয়। দেখা গেছে তখন সীমিত পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে অনেক রোগের আশঙ্কা কমে গিয়েছিল। এর ফলে সংক্রমণ জনিত রোগে ভুগে মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছিল। তবে খুব বেশি পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে গত সত্তর বছরে যে সুফল আমরা পেয়েছি সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সময় ঘুরে দাঁড়াবার
আর দেরি নয়। খাবারের উৎপাদন বারবার জন্য অ্যন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। না হলে সেই দিন আর খুব দূর নেই যখন কোনও ইংরেজি সাই-ফাই সিনেমাতে ঠিক যেমন ভাবে ভবিষ্তের পরিণাম দেখানো হয়, ঠিক তেমন ভাবেই আমাদের শরীরেও কোনও ওষুধ আর কাজ করবে না। এখনই যদি এই সব ওধুধের ব্যবহার বন্ধ না করা যায় তা হলে অচিরেই সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়বে মানুষ।
সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কী করণীয়?
অ্যান্টিবায়োটিক-রেসজসট্য়ান্ট বন্ধ করতে, হলে খুব প্রয়োজন না পড়লে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়াটা উচিত নয়। মাংস খাবার পরিমাণ সীমিত রাখুন কিংবা বাজারে মাংসের চাহিদা কমানোর জন্য মাংস খাওয়া ছেড়ে দিন। অর্গ্যনিক ফার্মে চাষ করা খাবারদাবার খান। এই সব ফার্মে শাক-সবজিতে বা মাংসে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয় না। বলা যতটা সহজ কাজে করা হয়তো অতটা সহজ হবে না, কিন্তু সুপারবাগের কবলে পড়ার থেকে এই অভ্যাস অনেক শ্রেয়।