চোদ্দোশাক কী, কার জন্য জ্বালা হয় আকাশপ্রদীপ?

ভূতচতুর্দশী মানে ভূতোপাসিতা চতুর্দশী, এ দিন চোদ্দোশাক খেতে হয়

 |  3-minute read |   05-11-2018
  • Total Shares

ফুলের সাজির মতো মাথাঢাকা ঝোড়ার মধ্যে সযত্নে বসিয়ে দেওয়া হয় একটা প্রদীপ। তারপরে পতাকা উত্তোলনের মতো করে ধীরে ধীরে সেটিকে আকাশের দিকে তুলে দেওয়া হয়। পুরো কার্তিক মাস ধরে গঙ্গারতির পরে এই দৃশ্য দেখা যায় বারাণসীর ঘাটে ঘাটে। লম্বা লম্বা বাঁশের এক্কেবারে উপরে ঝুলছে সেই আলো।

diya_akash_banaras_110518041137.jpgবারাণসীর গঙ্গার ঘাটে এখনও জ্বলে ঐতিহ্যের সেই আকাশপ্রদীপ (নিজস্ব চিত্র)

বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের সঙ্গে শকাব্দের কার্তিক মাসের সামান্য পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য বোঝা যায় সকালবেলা আকাশবাণী শুনলে। শকাব্দ মেনেই বারাণসীতে জ্বলে আকাশপ্রদীপ আর বাঙালির বাড়ির ছাদে জ্বলে বঙ্গাব্দের কার্তিক জুড়ে। 

কার উদ্দেশে এই প্রদীপ জ্বালানো হয় বলা খুব মুশকিল। সুবলচন্দ্র মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান অনুয়ায়ী আকাশদীপ বা আকাশপ্রদীপ শব্দের অর্থ হল লক্ষ্মী-নারায়ণের উদ্দেশে কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ প্রভৃতির উপর শূন্যদেশে যে প্রদীপ দেওয়া হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সঙ্কলিত ও সম্পাদিত বাঙ্গালা ভাষার অভিধান অনুযায়ী হিন্দুগৃহে দেবোদ্দেশে আকাশে যে দীপ দেওয়া হয়; বাঁশ পুঁতিয়া তার আগায় এই দীপ বাঁধিয়া দেওয়া হয় এবং কার্তিকমাস-ভোর প্রতি সন্ধ্যায় ঐ দীপ জ্বালা হয়। রাজশেখর বসু সংকলিত চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান অনুযায়ী, কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ ইত্যাদির উপরে যে প্রদীপ দেওয়া হয়

প্রথমে নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ্মীনারায়ণের নাম করা হলেও পরে সার্বিক ভাবে দেবতার কথা বলা হল এবং শেষে কার উদ্দেশে এই প্রদীপ তার উল্লেখ নেই। আমার ধারণা, ঈশ্বর ও পূর্বপুরুষ – উভয়ের উদ্দেশেই এই প্রদীপ জ্বালানো হয়। সময়ের সঙ্গে বদলেছে আকাশপ্রদীপ। এখন লোহার দণ্ডের উপরে জ্বলে বিদ্যুতের বাতি। 

diya_pann_110518041407.jpgপঞ্চপ্রদীপ ও কর্পূরদান, আরতির জন্য ব্যবহার করা হয় (নিজস্ব চিত্র))

পৌরাণিক ব্যাখ্যা থাক, বাঙালি হিন্দুধর্মালম্বীদের বিশ্বাস এই সময়ে পূর্বপুরুষরা এই আলোর নিশানা দেখেই ফেরেন তাঁর ঘরে। তাই কার্তিক মাসের কৃষ্ণচতুর্দশীতে পূর্বের চোদ্দো পুরুষের উদ্দেশে জ্বালা হয় চোদ্দোপ্রদীপ। এই দিনকেই বলা হয় ভূতচতুর্দশী, মানে ভূতোপাসিতা চতুর্দশী। ভূতের উপাসনার জন্য যে চতুর্দশী পালন করা হয়।

ভূত মানে সেই পাঁচটি জিনিস যা দিয়ে পৃথিবী তৈরি – ক্ষিতি (ভূমি), অপ (জল), ত্যেজ (সূর্য বা আগুন), মরুৎ (বাতাস) ব্যোম (শূন্য বা আকাশ)। মরে ভূত হয়ে যাওয়া মানেই নশ্বর দেহের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। সেই ভূতের উপাসনার জন্যই এ দিন হিন্দুদের ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয়।

পুরুষ শব্দের একটি অর্থ হল আত্মা। তাই চোদ্দোপুরুষের উদ্দেশে যে প্রদীপ জ্বালানো হয় তার এক অর্থ হল চোদ্দোটি আত্মার উদ্দেশে প্রদীপ জ্বালানো। আত্মা মানে এক জীবন্ত সত্ত্বা যার শরীর নেই। তাই তিনি পরলোকের বাসিন্দা হতে পারেন, ঈশ্বরও হতে পারেন।

diya_108_metal_110518041538.jpg১০৮ প্রদীপ: মাটির প্রদীপের দিন প্রায় গিয়েছে (নিজস্ব চিত্র)

আকাশপ্রদীপ নিয়ে বাংলায় একাধিক গানও রয়েছে। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে, মান্না দের কণ্ঠে জ্বালাও আকাশপ্রদীপ

একসময় হিন্দুধর্মে যাগযজ্ঞ হত। করতেন ব্রাহ্মণ ও ঋষিরা। ক্রমেই সেই আগুনই স্থান পেল গৃহস্থের ঘরে প্রদীপ হিসাবে। হিন্দুদের প্রায় সব উপাসনাতেই অগ্নির প্রয়োজন। ঈশ্বরের আবাহনে প্রয়োজন অগ্নি বা দীপ – পাদ্য ও অর্ঘ্যের পরেই ধূপ ও দীপ দিয়ে আবাহন করতে হয় ঈশ্বরকে। ঈশ্বর নিরাকার থেকে সাকার হয়েছেন, তবে অগ্নির উপাসনা বন্ধ হয়নি।

ভূতচতুর্দশীতে কী ভাবে চোদ্দোশাক খাওয়া শুরু হল বলা মুশকিল, যেমন বলা মুশকিল চোদ্দোশাকের মধ্যে কোনগুলো পড়ে। আজকাল ফুলকপির পাতা (কপিশাক) ধনেপাতা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। যতদূর জানা গেল নিম, সরিষা, হিংচে, পলতা, ঘেঁটু, ওল, বেতো, কেঁউ, কালকাসুন্দি, জয়ন্তী, শালিঞ্চা, গুলঞ্চ, শতপুষ্পা ও শুষনি। বাজারে গিয়ে চোদ্দোশাকের মধ্যে কী আছে তা জানতে চাওয়ায় উত্তর মিসল, “সব শাকই আছে – নটে, লালনোটে, কপি, আমরুল, পালং…” প্রভৃতি।

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু... সকলেই ছোট প্যাকেট ১০ টাকা ও বড় প্যাকেট ২০ টাকা দিয়ে কিনছেন।

সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলবে, চোদ্দোটা করে। পরের দিন দীপাবলি, দীপের উৎসব। কথিত আছে চোদ্দোবছর বনবাস ও রাবণবধের পরে কৃষ্ণঅমাবস্যায় অযোধ্যায় ফিরেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। ঘরে ঘরে দীপ জ্বালানো হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে। সেই থেকেই শুরু দীপাবলি, হিন্দিতে দিয়া থেকে দিয়ালি বা দিওয়ালি।

diya_home_110518042053.jpgবৈদিক যুগে যজ্ঞ হত, পরে প্রদীপ হয়ে তা প্রবেশ করে গৃহস্থের বাড়িতে (নিজস্ব চিত্র)

বিদেহীর উদ্দেশে নদীতে প্রদীপ ভাসানোর চলও আছে হিন্দুধর্মে। গঙ্গার তরঙ্গে ফুল আর বনস্পতির দীপ ভাসতে দেখে মনে পড়ে যেতে পারে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে সবিতা চৌধুরীর গাওয়া সেই গান –

গঙ্গা গঙ্গার তরঙ্গে প্রাণপদ্ম ভাসাইলাম রে/ গঙ্গা রাখিও যতনে বুকে নিয়া...

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment