সমাজে স্বীকৃতি না পেয়ে উদ্ধার হওয়া মেয়েরা ফের যৌনকর্মীর পেশায় ফিরে যাচ্ছে

যে সব পরিবারের কেউ কাজ পায় না সেই সব পরিবারেই ফাঁদ পাতে পাচারকারীরা

 |  6-minute read |   24-09-2018
  • Total Shares

বাংলার সাফল্যে আমরা অনেকেই গর্বিত কিন্তু দেশের মধ্যে বাংলা নারী ও শিশু পাচারে প্রথম, যা সংস্কৃতির রাজধানী বলে স্বীকৃত রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট লজ্জার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬ তথ্য অনুযায়ী সেই বছর রাজ্যে নারী ও শিশু পাচারের নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩,৫৭৯। ওই সময়কালেই রাজ্য থেকে ৫৩,৬৫৪ জন মহিলা এবং ১৬,৮৮১ জন শিশুও নিখোঁজ হয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কতজন পাচার হয়েছে সে ব্যাপারে কোনও পরিসংখ্যান নেই।

পাচারের কারণ এবং ধরন জানতে ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস (ডব্লিউবিসিপিসিআর) কলকাতা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই ২৪ পরগনায় ৪,১৪৩ জন যৌনকর্মীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায় যাতে জানা যাচ্ছে হোটেল, রিসর্ট ও এই ধরণের বেসরকারি এস্টাব্লিসমেন্টে মাইনর অর্থাৎ আঠারো বছরের কম বয়সী মেয়েদের সংখ্যা যৌনপল্লির তুলনায় অনেকটা বেশি। হোটেল-রিসর্টে নথিভুক্ত মেয়েদের মধ্যে নাবালিকাদের হার ১৮% সে ক্ষেত্রে যৌনপল্লিতে নাবালিকাদের হার ছিল ০.৮%। হোটেল, রিসোর্টে নথিভুক্ত মেয়েদের মধ্যে অধিকাংশেরই বয়স ১৫-১৭ বছর। সমীক্ষায় আরও একটি তথ্য জানা গিয়েছে পাচারকারী বা দালালদের মধ্যে ৬০% মহিলা এবং এদের বয়স ১৬-৬০ বছর। দেশের অন্যতম বৃহৎ যৌনপল্লি সোনাগাছিতে কর্মরত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, সোনাগাছিতে খাতায় কলমে গত কয়েক বছরে অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অনিচ্ছুক মেয়েদের সংখ্যা কমেছে।

body_092418122724.jpgতথ্য সূত্রঃ দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি

দক্ষিণবঙ্গের দুই ২৪ পরগনা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় পাচারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যার কারণ জেলাগুলি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগঠন বীরাঙ্গনা মহিলা সমিতির কর্ণধার আমিনা লস্কর জানাচ্ছেন, “দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মূলত আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়েদেরকে চিহ্নিত করে পাচার করা হচ্ছে। কারণ এদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি এবং প্রতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫-৯ জন যার মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ৩-৫ জন। কোনও উপযুক্ত পারিশ্রমিকের কাজ না থাকায় অভাব ও দারিদ্র্য এই সব পরিবারগুলির নিত্যসঙ্গী। আর এই অভাবের সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই প্রভৃতি বড় শহরে কাজ দেওয়ার নাম করে আবার কখনও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১২-৩০ বছরের মেয়েদের অন্য রাজ্যে পাচার করে দিচ্ছে তারা।”

body1_092418122807.jpgদক্ষিণ ২৪ পরগণায় নিজের বাড়িতে আয়েশা# [ছবি: লেখক]

কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে উদ্ধার হয়েছেন আয়েশা (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ২০০৯ আয়লার বছরে ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছিল, এখন থাকবার মতো দুটো ঘর রয়েছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫। মা স্থানীয় বাজারে ফল বিক্রি করেন, বাবা দিনমজুর। দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটছে। সম্প্রতি তাঁর পাচারকারী গ্রেপ্তার হয়েছে, তাই মাঝে মধ্যে আদালতে যেতে হয়। যে ছেলেটি তাঁর পাচারকারী সেই ছিল, বর্তমানে সেই তাঁর স্বামী।

গত কয়েক মাস আয়েশা পৃথিবীটাকে জানতে শিখেছে। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় পাশের গ্রামের একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। সম্পর্ক তৈরি হয়। আয়েশার কথায়, “ও আমাকে বলে আমি বিয়ে না করলে ও আত্মহত্যা করবে। আমি ওর ফোন ধরতাম না বলে আমার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করত। ভয় দেখাত আমি ওকে বিয়ে না করলে আমাদের ছবিগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করেছিলাম, সত্যি ভেবেছিলাম সবটা। একদিন বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে ওর সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। ও বলেছিল আমরা ওই দিনই বিয়ে করে নেব। প্রথমদিন আমরা দু'জন জীবনতলার কাছে একটা বাড়িতে ছিলাম তারপর কলকাতায় বাগুইআটির কাছে ওর এক দাদার বাড়ি। তার পরের দিন ওর সঙ্গে দিল্লি রওনা দিই, বলেছিল ওখানে ও কাজ পেয়েছে আমরা ওখানেই থাকব। বাড়িতে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম আমরা বিয়ে করেছি, চিন্তা না করতে। দিল্লি পৌঁছানোর পর আমায় একটা বাড়িতে নিয়ে গেল সেখানে আরও তিনটে লোক এল। সেই রাত থেকে ও আর এল না। এরপর আরও কয়েকটা বাড়িতে ছিলাম। ওরা মারধর করত, ওষুধও দিত, বাড়িতে যোগাযোগ করতে দিত না।।”

অনর্গল কথাগুলো বলেই চলেছেন আয়েশা। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক সমবয়সী মেয়ের ফোন থেকে একদিন মাকে ফোন করেছিল আয়েশা। সেই নম্বরের সূত্র ধরেই সিআইডি দিল্লির জিবি রোড অঞ্চল থেকে আয়েশাকে উদ্ধার করে গত বছর। এর মধ্যে প্রায় ছ'মাস কেটে গেছে। আয়েশা বাড়ি ফিরেছে, ভয় কাটেনি। কেস তুলে নেওয়ার জন্য চাপ আসছে। ওর বাবা-মাও চান না এই লড়াই লড়তে, মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চান। এক জোড়া কানের দুল আর চল্লিশ হাজার টাকা দিতে রাজি। শুধু বিশ্বাসযোগ্য পাত্রের সন্ধানে আছেন।

শান্তনু সরকার, ক্যানিংয়ের এক সমাজকর্মী জানাচ্ছিলেন, “আয়েশা একটা উদাহরণ মাত্র গোটা সুন্দরবন অঞ্চলে ঘরে ঘরে একই পরিস্থিতি। প্রেমের ফাঁদ পেতে, ভিনরাজ্যে কাজ দেওয়ার নাম করে কয়েক হাজার মেয়েকে পাচার করা হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে পুলিশে অভিযোগ অবধি নথিভুক্ত হচ্ছে না, কারণ পাচারকারী প্রভাবশালী। এমনও দেখা গেছে একই লোক একাধিক মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে পাচার করেছে এবং বর্তমানে গ্রামে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়েছে।”

গত কয়েক বছরে বেশ কেয়কজন মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে তবে এ ক্ষেত্রে মূল অন্তরায় হয়েছে সামাজিক স্বীকৃতি। কোনও ক্ষেত্রে মেয়েটির পরিবার মেনে নেয়নি। আবার কখনও মেয়েটি উপার্জনের জন্য পুনরায় অতীতের পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির তথ্যে। দুর্বারের তথ্য অনুযায়ী, “যৌনকর্মের পেশায় আসতে ইচ্ছুক মেয়েদের সংখ্যা ইদানীং বেড়েছে তার প্রধাণ কারণ ভিনরাজ্যের থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েরা সমাজে সম্মানের সঙ্গে কোনও কাজ করতে পারছেন না, ফলে পুনরায় এই পেশাকেই বেছে নিচ্ছেন।”

body2_092418122827.jpgতথ্য সূত্রঃ দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি

ডব্লিউবিসিপিসিআরের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তীর মতে, “গত কয়েক বছরে রাজ্যে নারী ও শিশু পাচার বেড়ে গেছে, ঘটনাটা এমন নয়। এখন পুলিশ প্রশাসন অনেক বেশী তৎপর তাই সমস্ত ঘটনাই নথিভুক্ত হচ্ছে। মেয়েটি যদি নাবালিকা হয়ে থাকে তাহলে তাঁর উদ্ধারে ডব্লিউবিসিপিসিআরের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে এবং আমরা চেষ্টা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েটিকে উদ্ধার করে বিচার সুনিশ্চিত করা যায়।” অনন্যা চক্রবর্তী দাবি করেন, পাচারের অভিযোগ যেমন নথিভুক্ত হচ্ছে তার সঙ্গে উদ্ধারের হারও বেড়েছে।

body3_092418122912.jpgদক্ষিন পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ যৌনপল্লি সোনাগাছি, এখানে মোটামুটি সতেরো হাজার যৌনকর্মীর বাস [ছবি: লেখক]

উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি -- এই দুই জেলায় নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা বেড়েছে যার প্রধান কারণ ডুয়ার্সের চা বাগানগুলির বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চা বাগানের কম মজুরি। ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা বাগানই বন্ধ বা রুগ্ণ। শ্রমিকরা সময় মতো ন্যূনতম পারিশ্রমিক পান না। বাড়তি রোজগারের আশায় অনেকেই অন্য রাজ্য বা পাশের দেশ ভুটানে যাচ্ছেন। গত কয়েক বছরে একটি আন্তর্জাতিক চক্র এই অঞ্চলে কাজ করে চলেছে যারা মূলত নেপালি ভাষাভাষীদের টার্গেট করে ভারতে থেকে নেপালি পাসপোর্ট বানিয়ে দিচ্ছে এবং সেই পাসপোর্টে তাদের দিল্লি থেকে সৌদি আরব, কুয়েতের মতো দেশে পাঠাচ্ছে। প্রথম কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলেও তারপর তাদের আর কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবার থেকে পুলিশে যোগাযোগ করার সাহস দেখায়নি কেউই, কারণ তারা নেপালি পাসপোর্টে দেশ ছেড়েছে, কাজেই ভারত সরকার কী ভাবে তাদের দেশে ফিরতে সাহায্য করবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা গত সাত বছরে পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে পারেননি। এ ছাড়াও ভুটান, নেপাল আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী জেলা এবং ন্যাশনাল হাইওয়ে সংলগ্ন হওয়ায় স্থানীয় ধাবাগুলিতে কমবয়সী মেয়েদের দেহব্যবসার কাজে লাগানো হচ্ছে।

সুন্দরবন অঞ্চলের এক সমাজকর্মী শুভশ্রী রাপ্তান জানাচ্ছেন, “আজকাল বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরিবারগুলি প্রেমঘটিত বিয়ে বা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলিকে পাচার বলে দেখানোর চেষ্টা করছে। আমরা গত এক বছরে সুন্দরবন এলাকার জেলা প্রশাসনের সহায়তায় “স্বয়ংসিদ্ধা” প্রকল্পের অধীনে কমবেশি চারশোটি স্কুলে সচেতনামূলক প্রচার করেছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, পঞ্চায়েত সদস্য এবং ছাত্রছাত্রীদের পরিবারকে পাচার সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকেটি পাচার এবং বাল্যবিবাহ আটকাতে পেরেছি।” প্রসঙ্গত “স্বয়ংসিদ্ধা” প্রকল্পটি প্রথম দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন বাস্তবায়িত করে। বর্তমানে প্রকল্পটি সাফল্য পাওয়ায় অন্যান্য জেলাগুলিতেও চালু করা হচ্ছে।

body4_092418123016.jpgস্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্পের অধীনে স্কুলছাত্রীদের মধ্যে সচেতনামূলক প্রচার চলছে [ছবি: লেখক]

উপযুক্ত আইনের অভাব, প্রমাণের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোষীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। কোনও ক্ষেত্রে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও রয়েছে। পাচার হওয়া মেয়েদের বিচার সুনিশ্চিত করতে গত ২৬ জুলাই লোকসভায় ট্রাফিকিং অফ পার্সন (প্রিভেনশন, প্রোটেকশান অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) বিল, ২০১৮ পাশ হয়েছে। সমস্ত স্তর থেকেই বিলটিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ-র মুখপাত্র প্রীতি মারাহা জানাচ্ছেন, “নারী ও শিশু সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, তবে বিলটিতে শিশু পাচারের ধরণ নিয়ে কিছু উল্লেখ নেই। যেমন দত্তক বা প্লেসমেন্ট এজেন্সির সাহায্যে শিশুশ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে পাচার হলে সে বিষয়ে কি ধরনের পদক্ষেপ হবে তার কোনও উল্লেখ নেই।” বিলটি এখনও রাজ্যসভায় পাস হয়নি।

#প্রতিবেদনে ব্যবহৃত পাচার হওয়া মেয়েটির নাম পরিবর্তিত।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TANMOY BHADURI TANMOY BHADURI @tanmoy_pj

Independent Photojournalist @TR_Foundation Contributor @pulitzercenter Fellow @TRF_Media Alumni @HuffPost Columnist @childcommission Award Winning Journalist

Comment