এ রাজ্যে পর্যটক আসে না কেন, টানার উপায় কী

পর্যটকরা ঠিক চান সেটা বুঝলে তবেই সমস্যা মিটবে

 |  5-minute read |   12-08-2018
  • Total Shares

লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটি। এ রাজ্যে আরও বেশি করে পর্যটক আনার জন্য বারে বারে এই বিষয়টির উপরেই জোর দিতে দেখেছি প্রশাসনকে, কয়েকটি বণিকসভাও এ নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা কিছু বলে থাকেন। কৌতূহল চাপতে না পেরে এক বার এক বিদেশি পর্যটন সংস্থার প্রধানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল পেরুর কথা। কোনও একটি চ্যানেলে দেখেছি পেরুর একটি গন্তব্যে কী পরিশ্রম করে পৌঁছলেন সেই ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি।

bishnupur_081218064927.jpgবিষ্ণুপুর বললেই লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটির কথা বলে অনেক স্থানীয় পর্যটন সংস্থাই

এ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখেছি, বাংলার অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো। মধ্যপ্রদেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সড়কপথে যেতে তো কালঘাম ছুটে যাওয়ার জোগাড় হত। তাও তো লোকে যায়। কেন যায়?

সমৃদ্ধ ইতিহাস যদি বেড়াতে যাওয়ার শেষ কথা হত, তা হলে ঝাঁসিতে ভিড় উপচে পড়ত। ঝাঁসিতে কই তেমন ভিড় দেখিনি তো! বারণসী, যেখানে প্রায় সারা বছরই পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে, সেখানে তো স্টেশন (মোগলসরাই হোক বা বারাণসী) থেকে নেমে গন্তব্যে যাওয়া বা ফেরার ট্রেন ধরার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর হয় না! তা হলে বাংলার দোষ কোথায়?

উপযুক্ত প্যাকেজের অভাব

মনে মনে একবার ভাবুন, টানা সাত দিন ছুটি নিয়ে রাজ্যের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন। কী দেখবেন কোনও পরিকল্পনাই করে উঠতে পারবেন না।

যান ট্যুর অপারেটরের কাছে। তাঁরা প্যাকেজ দেবে। কলকাতা, সঙ্গে তিনটি জায়গার মধ্যে একটি: সুন্দরবন, বিষ্ণুপুর ও দার্জিলিং। পর্যটক হিসাবে ভেবে দেখুন, সত্যিই কি মন ভরবে?

রণথম্ভোরের মতো অনেক জায়গাতেই বাঘ দেখা যায়। পান্নাতেও দেখা যায়। সুন্দরবনে বাঘ দেখা যাবে না। কপাল কতটা ভালো হলে দেখা যাবে তাও বলা যাবে না। তা হলে লোকে সুন্দরবনে যাবে কেন? ঠিক কী দেখতে যাবে? বিষ্ণুপুরে সব মন্দির একবার দেখার পরে বিকেলে একটু বসার জায়গা পাবেন কোথাও? অগত্যা আপাতত শান্ত দার্জিলিং।

victoria_memorial_ko_081218065212.jpgভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলেই দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রবেশ করেন

মাঝে একবার একটি বণিকসভা পরিকল্পনা করেছিল বৌদ্ধ সার্কিট বানানো হবে। কলকাতায় নেমে ভারতীয় জাদুঘরে বৌদ্ধ নিদর্শন, সেখান থেকে মোগলমারি হয়ে ওড়িশা। ওড়িশায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত নানা নিদর্শন আছে। বাস্তবে, বৌদ্ধ ধর্মস্থান বলতে পর্যটকরা যা বোঝেন তার সঙ্গে দার্জিলিংয়ের ঘুমের মিল থাকলেও অন্য কোনও জায়গার সঙ্গে মিল নেই। বৌদ্ধ উৎসব বলতে লোকের মনে বুদ্ধপূর্ণিমার কথা আসে না, আসে বিশাল বাদ্যযন্ত্র ও রণপা নৃত্য-মুখোশ নৃত্যের কথা।

তা ছাড়া কলিঙ্গে যে ভাবে বৌদ্ধ উপাসনাস্থল দেখা যায় তার সঙ্গে বুদ্ধগয়ার তুলনা চলে না। ধরনটাই আলাদা। যাঁরা বুদ্ধগয়া যেতে চান, তাঁদের এই সব অনাড়ম্বর ব্যাপার ভালো লাগবে না।

তোমরা খুঁজে নাও

রাজ্যে কী আছে? আরও ঠিক ভাবে প্রশ্ন করলে বলা যায়, রাজ্যে কী নেই! উত্তরে হিমালয়, তারপরে চা-বাগান, তার নীচে তরাই-ডুয়ার্সের বন। পশ্চিমে পাহাড়, শান্ত নদী, লালমাটি। দক্ষিণে সুন্দরবন।

গৌড়বঙ্গ, শান্তিনিকেতন, সারা রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা টেরাকোটা মন্দির, পঙ্খের কাজ করা মাঁকড় পাথরের মন্দির, পুরোনো রাজধানী মুর্শিদাবাদ আর রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা তো আছেই। কলকাতাতেই কত কী দেখার আছে!

gorumara-reuters_081218065314.jpgডুয়ার্সের অরণ্য এখনও উইকএন্ড ডেস্টিনেশন

সমস্যাটি এখানেই। মিশর বললে লোকে পিরামিড বোঝে, ইংল্যান্ড বললে বিগ বেন, ফ্রান্স-প্যারিস বললে আইফেল টাওয়ার, ভারত বললে তাজমহল। রাজ্যগুলির কথা ধরুন। রাজস্থান বললে দুর্গ (কোন দুর্গ পরের কথা), মধ্যপ্রদেশ বললে খাজুরাহো, কেরল বললে ব্যাকওয়াটার, বিহার বললে নালন্দা-বুদ্ধগয়া, ওড়িশা বললে জগন্নাথ মন্দির... কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বললে?

প্রথমবার কম খরচে বিদেশ মানে আমবাঙালি যায় ব্যাঙ্কক-পাটায়া। তারা জানে কী আছে ওখানে। কত জন বাংলাদেশ যান শুধু বেড়াতে যাবেন বলে? এ রাজ্যে পর্যটক মানে গঙ্গাসাগরের ভিড়! ছেলেবেলাতেও কলকাতায় যত বিদেশি দেখেছি, এখন আর চোখে পড়ে না। সঙ্গে ক্যামেরা না থাকলে অন্যরাজ্যের লোক দেখে অনেক সময়ই বোঝা যায় না তাঁরা ঘুরতে এসেছেন কিনা।

তাই এই রাজ্যের কোনও একটি বা দুটি জায়গাকে তুলে ধরা দরকার। যাঁরা আসবেন, তাঁদের অন্যত্র নিয়ে গেলই হল। যাঁরা ভারতে আসেন তারা তো আর তাজমহলটুকু দেখে ফিরে যান না!

দীর্ঘ পথে সুযোগ-সুবিধা

এ রাজ্যে কেন, এ দেশে রাস্তাঘাট খুব যে ভালো হবে না, এই ধারনা নিয়েই বিদেশিরা আসেন। সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। রাস্তাঘাটে প্রকৃতির ডাকে তাঁরা সাড়া দিতে পারেন না। ইন্ডিয়ান স্টাইল বলে যে ধরনের সুবিধা কদাচিৎ কোথাও পাওয়া যায়, সেটি আবার ওঁদের ব্যবহার করতে সমস্যা হয়, বিশেষ করে মহিলাদের। তাই এ রাজ্যে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার পরে অনেকেই এই বিশেষ সমস্যার কথা ভেবে নিজের দেশ থেকে এ রাজ্যে পর্যটক পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

দীর্ঘ পথ গাড়িতে যাওয়ার মাঝে একটু বিশ্রামের দরকার হয়। ভেবে দেখুন, কলকাতা থেকে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গেলে কোলাঘাটে একটি-দুটি জায়গা ছাড়া কোথায় কী সুবিধা রয়েছে। সুবিধা বলতে খাওয়ার সুবিধাই রয়েছে, শৌচাগার অনেক সময়ই ব্যবহারের অযোগ্য হয়।

থাকা-খাওয়া

ঘরের কাছে বিষ্ণুপুরে যান। হাত-পা ছড়িয়ে থাকার মতো হোটেল আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। সরকারি উদ্যোগে এখন কয়েকটি থাকার জায়গা হয়েছে, তবে রাজ্যের নিরিখে তা যৎসামান্য বললেও বেশি বলা হবে।

স্ট্রিট ফুড বলতে যা বোঝায় তা এ রাজ্যে কোথাওই পাওয়া যায় না কলকাতার কয়েকটি হাতেগোনা জায়গা ছাড়া। যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁরা স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে চান। কিন্তু এই শহরে কী খাবেন? বিভিন্ন ধরনের রোল ও ফুচকা রয়েছে, তবে কলকাতা পার হলেই তার মান যা হয়, তা খরচ করে বেড়াতে আসা লোকজনের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল।

পর্যটক-বান্ধব মনোভাবের অভাব

একবার কথা হয়েছিল ট্যাক্সি চালকদের প্রশিক্ষিত করা হবে। বড় আলোচনাচক্র ও সেমিনারে এমন অনেক কথা হয়, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেখানো হয়। পুরো পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায় ওই কক্ষের মধ্যেই। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কতজন ট্যাক্সিচালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা বলা যাবে না।

রিফিউজাল আরও বড় সমস্যা। তাই ধর্মতলার আশপাশের হোটেলে থাকা লোকজনের পক্ষে ঠিকঠাক ভাড়া দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

তা ছাড়া পর্যটকদের থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রবণতাও থাকে অনেকের। তাঁরা ঠকে যান বলেও এ রাজ্য সম্বন্ধে যথাযথ বার্তা যায় না তাঁদের দেশে।

এখন করণীয়  

কলতকাতা লন্ডন হলে কলকাতায় লোকে বেড়াতে আসবে কেন? কলকাতাকে কলকাতাই করতে হবে। তবে পরিচ্ছন্ন ও ঝুটঝামেলাহীন। ফুটপাথ হবে পথচারীদের উপযুক্ত ভাবে চলাচলের যোগ্য। অন্তত কয়েকটি জায়গায় ঠিকঠাক স্ট্রিট ফুডের বন্দোবস্ত করতে হবে। সেখানে বাঙালি খাবার যেমন লুচি (পুরী নয়), কচুরি (নানা ধরনের), সিঙাড়া (সামোসা নয়), জিলিপি, নানা ধরনের চপ, রোল এ সব রাখতে হবে। মোগলাই পরোটা, বিরিয়ানি থাকতে পারে। নানা ধরনের মিষ্টি থাকতে পারে, ফুচকা-ঘুঘনি, ঝালমুড়ি, নানা ধরনের চাট-মশলা থাকতে পারে।

durga_081218065041.jpgউৎসবের সময় শহর সেজে ওঠে, সেই সময় পর্যটকদের শহর দেখানো যেতে পারে

পর্যনকেন্দ্রগুলো পৌঁছাতে যে পথ ধরে যেতে হয় সেই সব পথে উপযুক্ত রোডসাইড ফেসিলিটির বন্দোবস্ত করতে হবে। সেটি হবে অনেকটা ক্যাফেটেরিয়ার মত। দরকারে আধশোয়া হয়ে জিরিয়ে নেওয়া যাবে। হালকা খাবার ও চা-কফি থাকবে। দরকারে ভারী খাবার বানিয়ে দেওয়ার সুবিধা থাকবে।

যাঁরা চালক হবেন, তাঁরা যেন বেশ কিছুটা গাইডের কাজ করে দিতে পারেন। যেতে যেতে রাজ্যের ঐতিহ্যের কথা বলতে পারেন সুন্দর ভাবে।

যে সংস্কৃতি সম্বন্ধে পর্যটকরা জানেন না, তা সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলে তাঁরাও আগ্রহী হতে পারেন। বছরের অন্য সময় এলে দুর্গাপুজোর সময় তাঁদের আসার জন্য আহ্বান করা যেতে পারে। কী ভাবে মণ্ডপ বানানো হয়, সে সব ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, বনেদি বাড়িতে তাঁদের ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

ট্রাম সারা দেশে অন্য কোথাও নেই। তাই টয়ট্রেনের মতো শহরের ট্রামে ভ্রমণ করানোও অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে। শব্দ হলেও তাতে কিছু যায় আসে না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment