অনলাইন পোর্টালের যুগেও পাড়ার ট্র্যাভেল এজেন্ট নীলুদার গ্রহণযোগ্যতা কমেনি কেন
নীলুদা 'দাঁড়িয়ে থেকে' সমস্যা মেটাতেন, একান্ত না মিটলে ওঁর কলার ধরে কৈফিয়ত চেয়ে রাগ কমানো যেত
- Total Shares
সময়টা মে মাসের শেষের দিকে। কলকাতায় তীব্র গরম, যদিও স্কুলগুলোতে গরমের ছুটি বেশ কিছুদিন আগেই পড়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই, ওই সময় মানুষের দৌড় পাহাড়মুখী।
আমি তখন গ্যাংটকে। দুপুরের খাবারের পর রাস্তায় অলস পায়চারি করে আসলে ধূমপানের সঠিক কোণ খোঁজার চেষ্টা করছি, কারণ শুধু শুধু জরিমানা দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না - এদের এই নিয়ম বড়ই অদ্ভুত। হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু, পাহাড়ের স্বভাব অনুযায়ী। দৈবাৎ একটা ছায়া পেয়েও গেলাম। এই পচা গরমেও এখানকার আবহাওয়া বেশ মনোরম, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মৃদু হাওয়া, পেট ভর্তি শুয়োরের মোমো-- বঙ্গসন্তানের বিদেশে নিয়ম নাস্তি!
আবহাওয়ার গুণে হৃদয়ে সাহসের সঞ্চার হয় তা প্রথম অনুভম করলাম। সাহস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ শুরু হল, হোক জরিমানা তবুও। ছুটির কারণে গ্যাংটকে ভিড় যথেষ্টই, তবে আমি টিবেট রোডে। সেখানে ভিড় তুলনামূলক কম। বৃষ্টিটা ক্রমশ বাড়ছে। হটাৎ খানিকটা জলের ঝাপটায় আমার সিগারেট এবং সাহস দুটোই নিভে গেল। তবে কি এরা পুরোটা টানতে না দিয়েই জরিমানা করবে? সঙ্গে সঙ্গে চমক ভেঙে পাশ থেকে নেপালিতে 'না' পরিষ্কার বাংলায় শুনতে পেলাম, "ভেরি সরি দাদা, ছাতাটা বন্ধ করতে গিয়ে আপনার গায়ে জল ছিটে গেল।"
অনলাইন পোর্টালে বুকিং করলে হোটেলের তরফ থেকে কোনো রিসিট দেওয়া হয় না, সুতারং হোটেলের কোনও দায় নেই
দেখি দুই মাঝবয়সী নিপাট গোবেচারা বাঙালি মূর্তি, বেশ বিধ্বস্ত। ঠিক কতকটা ফাঁদে পড়া নেংটি ইঁদুরের চেহারা। আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই একজন বলে উঠলেন, "কী বিপদেই পড়লাম বলুন তো মশাই, তিন মাস আগেও বুক করেও হোটেল পাব না কেন? সব টাকা অগ্রিম জমা দেওয়া, তাও?"
লৌকিকতা এবং কৌতূহল দু'য়ের বশেই প্রশ্ন করলাম, "কেন কী ব্যাপার?" যা উত্তর পেলাম সেটা আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ সংবাদ। ভদ্রলোক মাস তিনেক আগে একটি অনলাইন সংস্থা যারা হোটেল বুকিং করে তাদের অ্যাপ থেকে সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে ঘর বুক করেছিলেন। কিন্তু এখানে এসে হোটেল কর্তৃপক্ষ ওঁকে রুম দিচ্ছে না। কারণ ও সংস্থা নাকি হোটেলকে কোনও টাকাই দেয়নি। এবং যেহেতু, ভদ্রলোককে হোটেলের তরফ থেকে কোনও রসিদ দেওয়া হয়নি, সুতরাং হোটেলের কোনও দায় নেই।
সংস্থার নামটি আর উল্লেখ করলাম না, কে জানে লেখাটি পড়ে যদি মানহানির মোকদ্দমা করে দেয়, মোকদ্দমা আমি মোটেই ভালোবাসি না। যাক সে কথা, মোদ্দা ব্যাপার এখন ওই হোটেল খ্যাদানো লোকগুলোর কী হবে? তাঁরা বিগত দু'ঘণ্টা ধরে নতুন হোটেল খুঁজছেন। ছুটির জন্য এত ভিড় যে মনমতো হোটেল পাওয়াই যাচ্ছে না। আমি আমার হোটেলে ফোন করে খবর নিলাম, কপাল জোরে দুটি রুম পাওয়াও গেল এবং ওঁরা আমার হোটেলেই আশ্রয় নিলেন।
আমার এই অসীম উপকারের (ওঁদের ধারণায়) প্রতিদানে দুই ভদ্রলোক সেদিন সন্ধ্যায় চমৎকার পানাহারের ব্যবস্থা করলেন। আমি একা লোক। এমন সুযোগ কদাচিৎ মেলে, তাই জুড়ে গেলাম, আড্ডাও জমল। এই প্রথমবার এঁরা অনলাইন বুকিং করেছিলেন। এর আগে যতবার ঘুরেছেন ততবারই পাড়ার নীলুদা বলে এক ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে। আর সেই নীলুদার কথাই বারবার উঠে আসছে ওঁদের মুখে।
রঙিন অ্যাপের থেকে রক্তমাংসের মানুষের বেশি নির্ভরশীল
কী ভুলটাই যে করলেন! নীলুদা থাকলে যখনই কোনও সমস্যা হত, উনি 'দাঁড়িয়ে থেকে' মেটাতেন, কোনও সমস্যা হলে ওঁর কলার ধরে কৈফিয়ত চেয়ে রাগ কমান যেত। কিন্তু আজ ওঁরা কার কাছে কৈফিয়ত চাইবেন? সারা পৃথিবী জুড়ে যখন সবই অনলাইন, তবু এত ট্র্যাভেল এজেন্ট এখনও ব্যবসা করছে মনে হয় এই কারণেই। মানুষ মনে হয় এখনও রঙিন অ্যাপের থেকে রক্তমাংসের মানুষের উপর বেশি নির্ভর করে।
নৈশভোজ সেরে বেরোনর সময় আমার নম্বর চাইতে ভিসিটিং কার্ডটি ওঁদের দিলাম। এক বার চোখ বুলিয়েই একজন অবাক হওয়া হাসি হেসে বললেন, "আরে, আপনিও?" আমার উত্তর, "আজ্ঞে,হ্যাঁ।"
[পুনশ্চ: আপনার পাড়ার মোড়ের ট্র্যাভেল এজেন্টের 'গুণপনা' লিখব বলে কোনও সাজানো গল্পের আশ্রয় নিইনি। জীবনের সত্যিকারের অভিজ্ঞতা থেকেই স্মার্ট ফোনের যুগেও এই ট্র্যাভেল এজেন্টেদের গ্রহণযোগ্যতার কারণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম।]