অবনী হত্যা করা হল, তার শাবকদের বাঁচাতে এবার কি আমরা উদ্যোগী হব?
হাজারও প্রতিবাদের পরেও রাতের অন্ধকারে খুন করা হল বাঘিনীকে, আইনের তোয়াক্কা না করেই
- Total Shares
ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সমরে পরিণাম কী হবে সেটা আশু বিচার্য নয়, কী ভাবে মোকাবিলা করা হবে তার ধরনটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনও গণতন্ত্র যদি সুশাসন নিয়ে গর্ববোধ করে থাকে তাহলে সেই গণতন্ত্রও এক কথায় স্বীকার করে নেবে যে মোকাবিলার ধরনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন ধরুন কোনও সন্দেহভাজন জঙ্গির বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর সময় তার জেরা করা হয়। 'সাজানো ঘটনা' দেখিয়ে তাকে হত্যা করাকে গণতন্ত্র কখনও স্বীকৃতি দেয় না।
এই প্রেক্ষাপটে, মহারাষ্ট্রের বাঘিনী (যাকে মানুষখেকো বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল) সেই অবনীর সঙ্গে কী করা হল?
গভীর রাতে একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হল।
অবনী যে সত্যিই মানুষখেকো তা প্রমান করা গেল না [সৌজন্যে: ফেসবুক]
অনেকেই হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন তাতে সমস্যার কী রয়েছে? একজন ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বীকে কী হত্যা করা যাবে না?
সমস্যা বিস্তর। আর, সেই সমস্যাগুলোর কথাই আমি এখানে তুলে ধরব।
আমাদের চারপাশে একাধিক অবনী রয়েছে
ব্যাঘ্রপ্রকল্পের বাইরে থাকত অবনী। অনেক বাঘই প্রকল্পের বাইরে থেকে থাকে।
কিন্তু মূল প্রকল্পের বাইরের জমিগুলোতে শিল্পে স্থাপন করার চাপ থাকে। এই ধরণের কয়েকশো হেক্টর জমি সম্প্রতি শিল্প প্রতিঠানগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশে বাঘ, সিংহ ও চিতাবাঘের মতো প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সংঘাত বাধে এবং যত সংঘাত বাধে তার সিংহভাগই সংরক্ষিত এলাকার বাইরের জায়গাগুলোতে।
জমির চরিত্র বদলে দিয়ে প্রকল্প এলাকা ছোট করে দিলে এই সংঘাত যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দেখলেই এই সমস্যাগুলোর আভাস পাওয়া যায়।
বাছুর খেয়ে ফেলছে -- এই অজুহাতে অসমে এক বাঘিনীকে পাকড়াও করবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।
অক্টোবরে অসমের একটি চা-বাগানে একটি চিতাবাঘের বাচ্চাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
বাঘ বা চিতাবাঘদের ব্যাপারে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সকলের মনোভাব কেমন প্রকার হবে সে বিষয়ে জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের নিদিষ্ট নিয়মাবলী রয়েছে।
আর, এই নিয়মাবলীর কোথাও হত্যা করার কথা বলা নেই। বরঞ্চ, এই নিয়মাবলি বেশ যুক্তিপূর্ণ।
গভীর রাতে আসগর খান গুলি করে হত্যা করেছেন অবনীকে। কিন্তু আসগর খানকে গুলি করার অনুমতি কে দিল তা এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
সবচেয়ে বড় কথা, অবনীকে গুলি করার সময় রাজ্য সরকারের অনুমোদিত পশু চিকিৎসক সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন না। এই বিষয়টিও নিয়মবিরুদ্ধ। বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে মোকাবিলা করা মানে পরিণাম নয়, মোকাবিলার ধরনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনও গণতন্ত্র যদি সুশাসন নিয়ে গর্ববোধ করে থাকে তাহলে সেই গণতন্ত্রও এক কথায় স্বীকার করে নেবে যে ধরণটাই বেশি গুরত্বপূর্ণ।
I am deeply saddened by the way tigress Avni has been brutally murdered in #Yavatmal, #Maharashtra. #Justice4TigressAvni https://t.co/hX6wuf62Ec
— Maneka Gandhi (@Manekagandhibjp) November 4, 2018
ঠিক এই কথাটি বর্ষীয়ান পশু চিকিৎসক প্রয়াগ হদিগেড়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন:
"এই হত্যা বেআইনি, এটা খুন। এটা বেআইনি ভাবে পশু হত্যা। কী ভাবে পশু চিকিৎসকের উপস্থিতি ছাড়াই গুলি করা হল? রাতের বেলায় বাঘিনীর সন্ধান পাওয়াই বা গেল কী করে? সূর্য ডোবার পরে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতিই বা পেল কী ভাবে?
এই ওয়েবসাইটেই আমি আগে লিখেছি যে মানুষখেকোদের গুলি করা বা সরিয়ে ফেলাটাই রীতি।
কিন্তু তার জন্যও একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে।
কিন্তু অবনীকে বাঁচনোর জন্য এত প্রতিবাদ এত তর্ক বিতর্কের পরও যে ভাবে তাকে হত্যা করা হল তা যথেষ্ট লজ্জাদায়ক এবং যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ।
#অবনী বা টি-১ (ভালোবেসে এই নামে সম্বোধন করা হত) কিংবা পান্ধরকায়রার মানুষখেকো (হত্যাকারীরা এই নামেই তাকে সম্বোধন করতেন)দুই সন্তানের জননী অবনীকে হত্যা করার সময় সবরকম আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করা হয়েছে। অবনী মানুষখেকো ছিল না, অবনী শুধুমাত্র একটি মা ছিল যে তার সন্তানদের সুরক্ষা দিতে চেয়েছিল।
The brutal killing of T1, or #Avni as she was lovingly called, the mother of two 10 month old tiger cubs, the man-eater of Pandharkawda as her killers named her, violated every single protocol. She was no “man-eater”; just a mother trying to protect her kids. pic.twitter.com/MAwwfTTmxa
— Pritish Nandy (@PritishNandy) November 4, 2018
হাজারও প্রতিবাদে কোনও লাভ নেই
আর, এখানেই প্রশ্ন উঠছে যে প্রতিবাদ কি তাহলে এদেশে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে?
পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট প্রতিবাদ চলছে। দেশের জনগণ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অযৌক্তিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করে চলেছে।
মুম্বইয়ের বাসিন্দারা আরে জঙ্গল কাটা নিয়ে বছরের পর বছর প্রতিবাদ করে চলেছেন।
সরকারি আবাসন প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য গাছ কাটা নিয়ে প্রতিবাদ চলছে দিল্লিতে।
আরাবল্লি বায়ো-ডাইভার্সিটি পার্কের মধ্য দিয়ে সড়ক তৈরি নিয়ে প্রতিবাদে মুখর গুরগাওঁ।
পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবাদ নিয়ে কেউই বিচলিত নন [ছবি: এএনআই]
অবনীকে নিয়ে আবার একাধিক ভাবে প্রতিবাদ রয়েছে। কিছু প্রতিবাদী চেয়েছিল অবনীকে নিয়ে যেন কিছুই করা না হয়। আবার এক দল প্রতিবাদী বলেছিল তাকে যেন স্থানান্তরিত করে ফেলা হয়। তবে সকল প্রতিবাদই এক জায়গায় একমত ছিল -- অবনীকে যেন হত্যা না করা হয়।
কিন্তু মহারাষ্ট্রের বনদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গভীর রাতের এক রহস্যজনক ঘটনায় সকল প্রতিবাদীদের ভাষাই হারিয়ে গেল।
শুধু অবনীর মৃত্যু নয়, যে ভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবাদগুলোকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না তা কোনও মতেই সমাজের পক্ষে ভালো নয়।
প্রত্যেক রাজ্য সরকারের দায়িত্ব জনগণের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আর পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন মানে তো একটি অবলা বাঘ, ব্যাঘ্র শাবক বা গাছ নিয়ে প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তো আরও বেশি করে দেওয়া প্রয়োজন।
দয়া করে, ব্যাঘ্র শাবকদের বাঁচানো হোক
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অবনীর সন্তানদের সুরক্ষা সংক্রান্ত। তার দুই সন্তান এখন সংরক্ষিত এলাকার বাইরে রয়েছে। তাদেরও কি তাদের মায়ের মতো পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক থেকে গুলি করে হত্যা করা হবে? নাকি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে?
শাবকদের বাঁচানো যাবে তো? [ছবি: রয়টার্স]
হত্যা করা তো সহজ সমাধান। সঠিক সমাধানগুলো তো বেশ জটিল। বেশ সময়সাপেক্ষ।
মহারাষ্ট্রের বনদপ্তরকে চিঠি লিখে মহারাষ্ট্র রাজ্য বন্যপ্রাণী বোর্ডের সদস্য বিট্টু সেহগল এক সময় পরামর্শ দিয়েছিলেন যে অবনীকে যদি পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানে স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়। সেহগল এবার চিঠি মারফত শাবকদের ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন।
এই শাবকগুলোকে পুনর্বাসনে পাঠিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বন্য করে তোলার চেষ্টা করা যেতে পারে। এর আগে কানহা জাতীয় উদ্যানের শাবকদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল। যাই সমাধান নেওয়া হোক না কেন শাবকদের মানুষের দৃষ্টির আড়াল করতেই হবে।
বনদপ্তরের কাছে পাপের প্রায়ঃশ্চিত করার এটাই শেষ সুযোগ রয়েছে। অবনী কোনও দিনও বিখ্যাত হতে চায়নি। বনদপ্তর যদি প্রায়ঃশ্চিত করতে পারে তাহলে হয়তো বাঘিনীর আত্মা কিছুটা শান্তি পাবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে