ওয়াহাবিরা কেন ধর্মনিরপেক্ষতার পথে প্রকৃত প্রতিবন্ধকতা?
সুফিরা ওয়াহাবি গ্রন্থ ‘তাকিয়াত-আল-ইমাম’ নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন
- Total Shares
গণেশপুজোয় মুসলমানদের যোগ দেওয়া ও কেরলে বন্যার পরে মন্দির পরিষ্কার করার নিন্দার উৎস যে ওয়াহাবি শিক্ষার গ্রন্থ, সেই তাকিয়াত-উল-ইমাম: স্টেনদেনিং ফেথ বইটি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন সুফিরা।
ধর্মনিরপেক্ষতার ভাব ও গঙ্গা-যমুনা তেহজিবের (ভারতের বহুমুখী সংস্কৃতির উৎসব) মতো ছোট ছোট অনুভূতিগুলোর উপরে আঘাত হেনেছে গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া দু’টি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।
তিনি যে আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সেই বায়কুল্লায় গণেশের বিসর্জনের সময় ‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া’ ধ্বনি ওঠায় ওয়াহাবি মুসলমানদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন মুম্বইয়ে টেলিভিশন বিতর্কে পরিচিত মুখ তথা অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুন মুসলিমিন (এআইএমআইএম) বিধায়ক ওয়ারিস খান পাঠান।
‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া’ ধ্বনিত হওয়ার জন্য প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েছেন ওয়ারিস খান পাঠান (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)
ওয়াহাবিবাদ এবং কট্টর ওয়াহাবি মনোভাবের কেন্দ্র হিসাবে দীর্ঘজিন ধরেই পরিচিত বায়কুল্লা। তাই ভারতে দেওবন্দ ও আহলে হাদিসের মতো ওয়াহাবি ধারা যাঁরা মেনে চলেন তাঁদের প্রচারকদের প্রবল চাপের মুখে পড়ে তাঁকে ক্ষমা চাইতেই হয়েছে।
তবে তাঁর এই অবস্থান খারিজ করে দিয়েছেন পাঠানের নেতা এবং এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি।
সম্প্রতি কেরলে বন্যার পরে মুসলমানরা মন্দির পরিষ্কার করায় মুম্বই দক্ষিণ মুম্বই থেকে ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে অন্য একজন মুসলমান ধর্মপ্রচারক খুব কর্কশ ভাবেই তার নিন্দা করেছেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
গত দেড়শো বছর ধরে সমস্ত ওয়াহাবি মাদ্রাসায় যে বই পড়ানো হয়ে আসছে সেই তাকিয়াত-উল-ইমাম বইটি থেকেই এই ধরনের ঘৃণা ও ছড়াচ্ছে এবং তার ফলেই এই নিন্দা।
সুফিবাদ এবং সুফিরা যে ভাবে দরগায় সন্তদের পুজো করেন ও দরগায় কবরে চাদর চড়ান সে সবের বিরোধিতা করা হয়েছে তাকিয়াত-উল-ইমাম গ্রন্থটিতে এবং এই ধরনের আচরণকে অ-ইসলামীয় আচরণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে এই ধরনের রীতি হিন্দুধর্ম-সহ অন্য ধর্ম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
আরেকটি অর্থবহ ব্যাপার হল, পাকিস্তানি জঙ্গি মাসুদ আজহারও দেওবান্দি মতবাদ অনুসরণ করে এবং আহলে হাদিস মেনে চলে লস্কর-ই-তৈবার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সৈয়দ। সামান্য দু’একটা মতভেদ থাকলেও এই দুই মতবাদই মোটের উপরে একই রকম।
ওই গ্রন্থটি সৈয়দ আহমেদ বরেলভি ওয়াহাবিব শিষ্য ওয়াহাবি মৌলভি শাহ ইসমাইল লিখেছিলেন ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে। ইসমাইলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য যোগ রয়েছে। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইসলামীয় আন্দোলনকারী শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেলভির প্রপৌত্র যাঁর জন্য তৃতীয় পানিপতের যুদ্ধ হয়েছিল।
‘কাফির মারাঠা’দের ধ্বংস করে ভারতে গোঁড়া মুসলমানি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আফগান হামলাকারী আহমেদ শাহ আবদালিকে উৎসাহ দিয়েছিলেন ওয়ালিুল্লাহ। সম্রাট আকবর যে শাসন থেকে বিচ্যুত হয়ে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে ছিলেন তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাননি ওয়ালিউল্লাহ।
ইসমাইল ও তাঁর গুরু বরেলভি দু’জনেরই মহারাজা রণজিৎ সিংহের পুত্র শের সিংহের নেতৃত্বাধীন শিখবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৮৩১ সালে অধুনা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বালাকোটের যুদ্ধে মৃত্যু হয়। এখনও বালাকোটে গেলে ইসমাইলের সমাধি দেখা যেতে পারে। খুবই সাদামাটা একটা সমাধি, কোনও নকশা করা নেই, শুধুমাত্র ওয়াহাবি মতবাদ লেখা রয়েছে।
ঘটনা হল, মহম্মদ কাশিম নানোৎভি ও রাশিদ আহমেদ গঙ্গোহি যবে দেওবন্দ শিক্ষার প্রচলন করেন এবং আহলে হাদিসের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নাজির হুসেনের আমল থেকে, অর্থাৎ বিগত দেড়শো বছর ধরে দেওবান্দি ও আহলে হাদিসের সব নেতাদের মধ্যেই শাহ ইসমাইল এবং তাঁর গ্রন্থ জনপ্রিয়।
জমিয়ৎ উলেমায়ে হিন্দের (জেইউএইচ) প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ হুসেন মাদানিও এই গ্রন্থটিকে কার্যত পুজো করেন। দুঃখের ব্যাপার হল, ইসমাইল ও তাঁর ঘৃণাপূর্ণ উক্তিসম্পন্ন এই গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন মহান জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা আবুল কালাম আজাদ, যিনি আবার দু’বারে মোট সাত বছর কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। তাঁর আরবি লেখায় ইসমাইল ও তাঁর গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন আজাদ।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইসলামীয় ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে মাদানি যে বিখ্যাত বক্তৃতার জন্য প্রিয় তা হল ১৯৪৫ সালে তাঁর করা এক ঐতিহাসিক মন্তব্য যেখানে ব্র্যান্ড ইসলামের প্রতি তাঁর গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “যদি ঔরঙ্গজেবের সঙ্গের যুদ্ধের ফলে দারা শিকো (সম্রাট শাহ জাহানের সুফি পুত্র) মোগল সম্রাট হতেন তা হলে হয়তো মোগল সাম্রাজ্য রক্ষা পেত কিন্তু হয়তো ইসলাম শেষ হয়ে যেত। তবে ঔরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ায় মোগল সিংহাসন ও ইসলাম দুই-ই রক্ষা পেয়েছে।”
ঘৃণা ছড়ানের জন্য তাকিয়াত-উল-ইমাম: স্ট্রেনদেনিং ফেথ বইটির নিন্দা করেছেন সুফিরা
১৯৪৫ সালেই দিল্লিতে জেইউএইচের অন্য একটি সভায় মাদানি বলেছিলেন যে, ইসলামের নামে মহম্মদ আলি জিন্না ভারতের একটিমাত্র অংশ দাবি করে ইসলামের মারাত্মক ক্ষতি করছেন, কারণ তিনি এই মতবাদকে একটিমাত্র অংশে আবদ্ধ করে ফেলছেন। অর্থাৎ এক ভাবে বিচার করলে তিনি ইসলামের জন্য পুরো ভারতকেই চেয়েছিলেন।
মুসলিম পলিটিক্স ইন সেকুলার ইন্ডিয়া নামে গ্রন্থে সুন্দর ভাবে মাদানির এই দুই ঘটনা বর্ণনা করেছেন সংস্কারপন্থী মুসলমান নেতা হামিদ দলওয়াই।
কোঙ্কনি মুসলমান দলওয়াই ১৯৮৪ সালে মুম্বইয়ে মারা যান, তবে আধুনিক ইসলামের প্রতীক হিসাবে আজও তিনি শ্রদ্ধেয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, শাহ ইসমাইল আজও সৌদি আরবে মহান ব্যক্তি হিসাবে সম্মানিত এবং বিমানবন্দর ও বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে তাঁর গ্রন্থ তাকইয়াত-উল-ইমাম বিনামূল্যে বিলি করে বিভিন্ন ওয়াহাবি গোষ্ঠী।
ওয়াহাবি মাদ্রাসাগুলিতে তাকিয়াত-উল-ইমাম: স্ট্রেনদেনিং ফেথ বইটি পড়ানো হয় (সৌজন্য: টুইটার)
রিয়াধের দারুসসালাম পাবলিশার্সের সদর দফতর, তারাই তাকইয়াত-উল-ইমাম গ্রন্থটির প্রকাশক এবং তারা সম্ন্তরাল ইতিহাস বইয়ে ইসমাইলকে মহান ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরে বলেছে, “তিনি একই সঙ্গে কলম ও তলোয়ার দিয়ে জিহাদ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামের জন্য শহিদ হয়েছেন।”
এই প্রকাশক বলেছে, “ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের আগে থেকেই তারা ছিল এ কথা বলার পরেও এবং হিন্দুদের পৌরাণিক বিশ্বাস ও রীতিনীতি দেখার পরেও ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এতটাই ছিল যে আল্লাহের পাশাপাশি অন্য কেউও আছেন এই ধরনের অবক্ষয়মূলক ধর্মীয় ভাবনা ও ইসলামে এই ধরনের চিন্তার উদয় কোনও মতেই মেনে নিতে পারতেন না শাহ ইসমাইল শাহিদ। তাই আমাদের অ-ইসলামীয় কার্যকলাপ রুখতে ও মুসলমানদের সত্যিকারের ধর্মের পথে ফেরাতেই তিনি তাকইয়াত-উল-ইমাম গ্রন্থ রচনা করেছেন।”
সুফি মতাবলম্বীরা এই গ্রন্থর সমালোচক এবং এটিকে কার্যত বিষময় বলে মনে করেন।
সুন্নি ইউথ উইংয়ের সভাপতি এবং যিনি তাকইয়াত-উল-ইমাম গ্রন্থটির বিরুদ্ধে সেই ওয়াসিম শেখ বলেন, “সুফিবাদ ও অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের জন্য এই বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। তারুণ্যের সময় মুসলমানদের জঙ্গিবাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে এই গ্রন্থটি।”
শেখের কথা অনুযায়ী, “তাকইয়াত-উল-ইমাম গ্রন্থটি আইসিসেস মধ্যেও বিলি করা হয়। সুফিদের সংগঠন মুসলিম স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি শুজাত আলি কাদরি বলেন, যত শীঘ্র এই গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হবে তা দেশের গঙ্গা-যমুনা-তেহজিবের পক্ষে ভালো হবে।”
সরকার বাহাদুর কি শুনছেন?
ধর্মনিরপেক্ষতার – বা ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা কি শুনছেন?
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে