শুধু উজ্জীবিত করতে পারলেই চলবে না, বিরাট ও শাস্ত্রীকে আরও বেশি কিছু দিতে হবে
বিদেশে জিততে হলে সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও স্ট্র্যাটেজির উপরও জোর দিতে হবে
- Total Shares
হার নয়, এ যেন আত্মসমর্পণ। লর্ডস (সিরিজের দ্বিতীয়) টেস্টে এক ইনিংস ও ১৫৯ রানে ভারতকে পরাজিত করেছিল ইংল্যান্ড।
এই ম্যাচে ইংল্যান্ডের গড় রান ভারতের গড় রানের থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ছিল। এটা ভারতের হোম সিরিজ নয়। বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে কোহলিরা যে পারফর্ম্যান্স মেলে ধরেছিল তার সিকিভাগও ইংল্যান্ডের মাটিতে তারা দেখতে ব্যর্থ। ভারতীয় ক্রিকেট দলকে আমরা যতটা চিনি তাতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তৃতীয় টেস্টেও আবার আত্মসমর্পণ করতে চলেছে টিম ইন্ডিয়া। অনেকের মনেই বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে সিরিজের ফলাফল ৫-০ হওয়াটা আর সম্ভাবনার পর্যায়ে নেই। তা এখন ঘোর বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে।
ভারতীয় ক্রিকেট দলের সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ীরাও যদি এটা আশঙ্কা করে থাকেন তাহলে তাঁরা ভুল কিছু করেননি। কারণ, এত বড় ব্যবধানে হারের পরেও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা ঘুম ভেঙ্গে উঠে দলের খোলনলচে বদলে দেবেন তা কেউই দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
আসলে, অতীতের এই ধরণের ঘটনার নিদর্শনের ভারতীয় ক্রিকেটে খুব বেশি নেই।
ভারতীয় দলের অধিনায়কত্বের মুকুট যখন মহেন্দ্র সিং ধোনির মাথায় তখন ভারতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন ডানকান ফ্লেচার। ধোনি আর ফ্লেচারের ব্যক্তিত্ব অনেকটাই এক হওয়ায় সেই সময় ভারতের ড্রেসিং-রুমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ধোনির ক্রিকেট মস্তিষ্ক প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই সময় ভারতের একজন অধিনায়কের প্রয়োজন ছিল যিনি দলকে মোটিভেট করতে পারবে। কিন্তু ভোকাল টনিক চিকিৎসায় ধোনী খুব একটা সিদ্ধহস্ত নন। তাই ২০১০ সালের পর ধোনির ভারত বিদেশের মাটিতে খুব একটা ভালো খেলতে পারেনি।
ধোনী-ফ্লেচার জুটির রাজত্বকালে বিদেশে ভালো খেলতে পারেনি ভারত [ছবি: রয়টার্স]
বিরাট কোহলি আর রবি শাস্ত্রীর ব্যক্তিত্বটাও অনেকটা একই রকমের। কিন্তু এই জুটি কিন্তু ধোনী-ফ্লেচার জুটির থেকে একেবারে অন্যরকম। ভোকাল টনিক বা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। বলতে গেলে, বিরাট আর শাস্ত্রীর এই ক্ষমতার জন্যেই টেন্টব্রিজে ২০৩ রানে ইংল্যান্ডে হারিয়ে সিরিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারত।
কিন্তু শুধুই এই ক্ষমতায় কি একটা দলকে টেনে তোলার জন্যে যথেষ্ট?
ক্রিকেটদলের অধিনায়ক মানেই কি শুধু দলকে উজ্জীবিত করতে পারা। ২-০ পিছিয়ে থাকার পর তৃতীয় টেস্টে অনবদ্য জয়। উৎসবে মেতেছে ভারত। কিন্তু এই উৎসবের মাঝেও একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না: সিরিজের প্রথম দুটি টেস্টে পরাজিত হয়েছিল ভারত। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে কোহলি-শাস্ত্রী জুটির মাত্রাতিরিক্ত ঔদ্ধত্ব ও জেদের জন্যেই দুটি টেস্টে ভারতকে হারতে হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট হারের দায় অবশ্য ক্রিকেট বোর্ডের উপর চাপানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে পরপর খেলার এত চাপ ছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু দলের নেতৃত্বও এই হারের জন্যে সমান ভাগীদার।
সেই সময় চোটাঘাতে ভুগছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। কিন্তু তাঁকে সুস্থ হওয়ার সময়টা না দিয়ে জোর করে একদিনের সিরিজে খেলিয়ে দেওয়া হল। এর ফল টেস্ট সিরিজে ভুগতে হল ভারতকে। চোটের জন্যে টেস্ট সিরিজ খেলতেই পারলেন না তিনি। ইংল্যান্ডের উইকেটে টেকনিক সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে মুরলী বিজয়ের। কিন্তু তিনি যাতে সিরিজ শুরুর আগে ইংল্যান্ডের পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন তার কোনও চেষ্টাই করা হল না। মুরলী বিজয়রের পরিবর্তন খোঁজারও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হল না।
কোহলি-শাস্ত্রী ঔদ্ধত্ব ও জেদের জন্যেই প্রথম দুটি টেস্টে ভারতকে হারতে হয়েছে [ছবি: পিটিআই]
শিখর ধাওয়ান যেমন। প্রায় প্রতিটি বিদেশ সফরে ধাওয়ান প্রমাণ করেন যে বিদেশের মাঠে তাঁর টেকনিক একেবারেই মাননসই নয়। কিন্তু তার পরেও তিনি বারংবার সুযোগ পেয়ে থাকেন। পূজারাকে সাইডলাইন করে রাখা হয়, রাহানে বা রাহুলকে খুব বেশি সুযোগ দেওয়া হয় না, শামির ধাবাহিকতার অভাবকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় না, সর্বোপরি কুলদীপকে কোনও যুক্তি ছাড়াই লর্ডসে প্রথম একাদশে দলে নেওয়া হল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আগেই সিরিজ হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। জো'বার্গে তো শুধুমাত্র সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে নেমে ছিলেন কোহলিরা। কিন্তু এর পরেই একদিনের সিরিজ এবং টি-২০ সিরিজ ভারত জিতে নেওয়ায় টেস্ট সিরিজ হারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। একদিনের সিরিজ ৫-১ ফলাফলে জিতে যাওয়ায় টেস্ট সিরিজে ২-১ ফলাফলে হার আমরা মাফ করে দিয়েছিলাম।
টেস্ট সিরিজ হার কোনওভাবেই একদিনের সিরিজ জয় করে পূরণ করা যেতে পারে না। টেস্ট ক্রিকেটে একেবারে অন্যরকম মানসিকতা ও প্রতিভার প্রয়োজন। তাই কোহলি ও শাস্ত্রীর উচিত ছিল বিদেশের মাটিতে পরিবর্তী সফরের আগে টেস্ট সিরিজের ব্যর্থতার কারণগুলো ঝালিয়ে নেওয়া। তা কিন্তু তাঁরা করেননি। এই মুহূর্তে ভারতের একটাই আশার রয়েছে - সিরিজে আরও দুটি ম্যাচ বাকি রয়েছে, তাই সিরিজে হার এড়ানো যেতে পারে।
পাঁচ টেস্টের সিরিজ এখন খুব একটা বেশি খেলা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারত দুই কী তিনটি টেস্টের সিরিজ খেলে। সুতরাং, শাস্ত্রী-বিরাটের প্রথম দুটি টেস্টকে প্রস্তুতি ম্যাচ হিসেবে দেখার ফর্মুলা খাটবে না।
দলকে উজ্জীবিত করতে পারা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটাই অধিনায়কের একমাত্র কাজ হতে পারে না। বিদেশে ভালো পারফর্ম করতে হলে প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও স্ট্র্যাটেজিরও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। বিরাট শাস্ত্রীর উচিত অনতিবিলম্বে এই বিষয়গুলোর উপর জোর দেওয়া।