সন্ত্রাসবাদ: পশ্চিমবঙ্গ কেন জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে?
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর বীরভূমের সরকারি জমিতেও জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরের সন্ধান মেলে
- Total Shares
রিপোর্টটির মধ্যে অনেকেই রাজনীতির গন্ধ পেতে পারেন। বলতেই পারেন, রিপোর্টটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনদিত। তাই বলে, রিপোর্টটির সত্যটা নিয়ে কিন্তু কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
২০১৬ সালের সেই রিপোর্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের। রিপোর্টটিতে বলে হয়েছিল, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি গত দেশ জুড়ে ৪৬জনকে আইএসআই-এর সঙ্গে যোগসাজশের সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১৬জনকে। অর্থাৎ, এক তৃতাংশের বেশি। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছিল রাজস্থান ও পাঞ্জাব।
এই রিপোর্টটির থেকে একটি বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ও সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়। এই রিপোর্ট প্রকাশের দিনদুয়েকের মধ্যে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) এক অফিসার জানিয়েছিলেন, রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে ১৬টি গ্রেপ্তারির কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ১০জনকে শুধুমাত্র ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের একটি ঘটনা এবং এই ঘটনার পরবর্তী তদন্তে উঠে আসা নানান বিস্ময়কর তথ্য বেরিয়ে আসার পরেই এই রিপোর্টটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঠিক পরেই [ছবি: এপি]
২০১৪ সালের দোসরা অক্টোবর রাজ্যের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্তে নেমে জানা যায় যে বাড়িটিতে উগ্রপন্থীরা ভাড়া নিয়ে ছিলেন। তদন্তভার এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়। তদন্তে নেমে মোট ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের অধিকাংশ জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্য। এদের জেরা করে জানা যায় যে জেএমবির সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও নদীয়াতে খুব দ্রুত ঘাঁটি গেড়ে চলেছে। বাংলদেশের শেখ হাসিনা সরকারকে ফেলে দেওয়াই এই জঙ্গিসংগঠনের মূল উদ্দেশ্য মূল উদ্দেশ্য।
শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকার পতনের উদ্দেশ্যেই যে জঙ্গিরা এই রাজ্যে ঘাঁটি বাঁধছেন এমন নয়। তদন্তে জানা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথা সরকারি দপ্তরের 'ভিতরকার' খবর বা গোপন তথ্য ব্যবহারের জন্যে এই জঙ্গিদের ব্যবহার করছে আইএসআই। অবশেষে তদন্তে উঠে আসা এই সন্দেহটিও সত্যি বলে প্রমাণিত হল।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার কেন্দ্রস্থল থেকে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। ধৃত তিনজন জেরায় কবুল করেছিল গার্ডেনরিচের জিআরএসআই থেকে, যেখানে নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি হয়, গোপন তথ্য আইএসআইকে সরবারহ করছিলেন তারা।
যদিও, এর পরে, এই সংক্রান্ত আর কোনও রিপোর্ট এখনও স্বরাষ্ট দপ্তর থেকে প্রকাশ করা হয়নি, সম্প্রতি বাংলাদেশের গোয়েন্দারা যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাও কিন্তু যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। ২০১৭ সালের মার্চ মাসের রিপোর্টিতে বলা হয়েছিল, ২,০১০জন হুজি ও জেএমবি সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের তিনটি রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে ৭২০ জন পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। বাকি ১,২৯০জন অসম ও ত্রিপুরা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এদের অধিকাংশই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় 'নিরাপদে' রয়েছেন।
এক বছরের ব্যবধানে দুটি রিপোর্ট থেকে একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। জঙ্গি সংগঠনগুলো বা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদেরা বরাবরই পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদবোধ করে থাকে। কিন্তু কেন?
এনআইএর তদন্তে উঠে আসে অনেক বিস্ময়কর তথ্য [ছবি: পিটিআই]
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান এই তিনটি দেশেই পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে লাগোয়া এই তিনটের দেশের সীমান্তের অনেকখানি অঞ্চলেই নিরাপত্তার কোনও বালাই নেই। কিন্তু জায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ঢিলেঢালা। আর, এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা।
দুই, এ রাজ্যের বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের লোকেদের কথাবার্তা আচার আচরণ অনেকটাই সীমান্তের ঠিক ওপারের অঞ্চলগুলোর মতো। তাই একবার সীমান্ত টপকে এপারে চলে আসতে পারলেই কেল্লা ফতে। বাংলদেশের নাগরিকের সঙ্গে (ভারতের) পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের আলাদা করতে পারা বেশ দুঃসাধ্য। তদন্তে বারবার দেখা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া এলাকাগুলোর দুদিকেই একই পরিবারের সদস্যরা (বা আত্মীয়রা) থাকেন। সীমান্ত টপকে আত্মীয়ের বাড়িতে সহজেই আশ্রয় পাওয়া যায়।
সজ্ঞানে বা জেনে না করলেও, রাজনৈতিক ভাবেও এ রাজ্যে সাহায্য পান জঙ্গিরা। এনআইএ বা কলকাতা পুলিশের এসটিএফ-এর তদন্তে বারংবার উঠে এসেছে যে এ রাজ্যে 'আশ্রিত' জঙ্গিদরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদতে জুটিয়ে ফেলেছে এ দেশের সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র। আর, এপিক কার্ড জোগাড় করে ফেলা মানে কিন্তু একজন সরকারি ভাবে এ দেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন।
সচেতনতার অভাবও রয়েছে। কয়েক বছর আগে কলকাতার মেটিয়াব্রুজ অঞ্চলের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর এনআইএর তদন্তে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের সঙ্গে মেটিয়াব্রুজের সেই বাড়িটির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তদন্তে জানা গিয়েছিল, বাংলদেশ থেকে আগত জঙ্গিরাই বিস্ফোরণের সময়ে সেই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে ছিলেন। দর্জি ব্যবসার আড়ালে চলত বিস্ফোরণ তৈরির কাজ। অথচ, স্থানীয় থানাতে এই ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে কোনও তথ্যই ছিল না।
কলকাতা পুলিশের নিয়ম রয়েছে যে ভাড়াটিয়া রাখলে স্থানীয় থানাতে ভাড়াটিয়ার পরিচয় সংক্রান্ত নথি জমা দিতে হবে। কিন্তু সেই নিয়ম অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই পালন করে না। পুলিশকে জানানো তো দুরস্ত, নিজেরাও অনেক সময় ভাড়াটিয়াদের পরিচয় জানতে চাননা। পুলিশও কোনও দিনও এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করতে সক্রিয় হয়নি। কিন্তু কেন? এর সদুত্তর আজ পর্যন্ত কোনও পুলিশ আধিকারিকই দিতে পারেননি।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি জমিও ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে জঙ্গিদের। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঠিক পরেই এনআইএর গোয়েন্দারা বীরভূম শহরের ঠিক বাইরে মুলুক গ্রামে এক বিঘা জমির উপরে তিনটি বাড়ির সন্ধান পান। তদন্তে জানা যায় এই তিনটি বাড়ি থেকে একটি প্রশিক্ষণ শিবির চালাত জেমএমবি সদস্যরা। জমির মালিকের নাম জানলে খানিকটা অবাক তো হতেই হয় - পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
প্রশ্ন উঠছে সরকারি জমিতে জঙ্গি শিবির প্রতিষ্ঠিত হল কী ভাবে। তদন্তে সরকারি নথি ঘেটে দেখা গিয়েছিল এই জমির আসল মালিক ছিলেন স্থানীয় এক জমিদার। বর্গা আইনে সরকার এই জমি অধিগ্রহণ করে স্থানীয় আদিবাসীদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কথা চিন্তা করে। সেই চিন্তা অবশ্য ফলপ্রসূ হয়নি। উল্টে, স্থানীয় এক জমি বাড়ির দালাল জাল কাগজপত্র বানিয়ে সেই জমি একজনকে বেঁচে দেন। তদন্তে জানা গিয়েছিল যিনি এই জমি কিনেছিলেন তাঁর সঙ্গে জঙ্গিদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল।
এই কাগজ জাল করার সময়ে স্থানীয় বিএলআরও দপ্তরের বেশ কিছু কর্মী ও আধিকারিকের গাফিলতি নজরে আসে। তাঁরা হয়ত জানতেন না যে তাঁদের ভুলে (বা ইচ্ছাকৃত ভুলে) এই জমি জঙ্গিদের হাতে চলে যাবে। তবুও, ভুল ভুলই। আর, এ ভুলের কোনও ক্ষমা হয় না।
এই ধরণের ভুল জোট ঘটবে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু ততই জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে।