ভুয়ো খবর ও ভিত্তিহীন বিজ্ঞানচর্চার কেন বিরোধিতা করা দরকার
এই পদ্ধতি এখন বদলের প্রয়োজন
- Total Shares
ভুয়ো খবরের রমরমার দেখে মনে হচ্ছে যে আমরা এমন একটা যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে বিজ্ঞানও ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে।
ভুয়ো খবর যেমন মানুষের চোখে পড়ে বা সেগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষ সেই খবরগুলো নিয়মিত পড়েন ঠিক তেমন ভাবেই ভিত্তিহীন বিজ্ঞান প্রকাশ্যে থাকলেও মানুষ কিন্তু সেটা ধরতে পারেন না।
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে যে ভিত্তিহীন বিজ্ঞানের কুপ্রভাব হয়তো শুধুমাত্র বিজ্ঞানশিক্ষা বা বিজ্ঞান চর্চার উপরেই পড়বে সাধারণ মানুষের উপর তার কোনও প্রভাবই নেই।
কিন্তু এই ধারণাটা সত্যি নয়। ভিত্তিহীন বিজ্ঞানের একটা মারাত্মক প্রভাব রয়েছে।
প্রথমে দেখা যাক সমস্যাটা ঠিক কী?
বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে এটা নতুন তথ্যর সৃষ্টি হয় এবং সেই তথ্য বা আবিষ্কার আরও অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়, এভাবেই সেসব তথ্য সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কোনও বৈজ্ঞানিক যদি নতুন কিছু আবিষ্কার করেন তাহলে প্রথমেই সেই আবিষ্কার বা উদ্ভাবনটির যেকোনও একটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত জার্নালের রিসার্চ পেপার হিসেবে প্রকাশ করে ঘোষণা তার করা হয়। এর মূল উদ্দেশটা হল এই যে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যাঁরা এই একই বিষয় কাজ করছেন তাঁরা যেন আবিষ্কারের এই নতুন দিকটার সম্বন্ধে অবগত হন এবং এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে নিজেদের গবেষণাকে প্রয়োজনীয় দিশা দিতে পারেন। এভাবেই আজ থেকে প্রায় একশো বছর কী তারও আগে শ্রেষ্ঠ্য কয়েকটি গবেষণা মানুষের সামনে উঠে আসে।
বিশ্বের সবচেয়ে নামজাদা সাইন্টিফিক জার্নালগুলি যেগুলো বিভিন্ন শিক্ষায়তন, পেশাদার সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকাশ করে সেসব জার্নালে যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয় সেগুলি সেই বিজ্ঞান ক্ষেত্রের অন্যান্য গবেষকরা পড়েন ও পর্যালোচনা করেন। তারপর সেই গবেষণা ভিত্তিক লেখাটি অনুমোদন বা স্বীকৃতি পায়। লেখাগুলি পড়ার জন্য সেই জার্নালটি কিনতে হয়। বহু বছর ধরে এই ধরণের জার্নাল চাপানো ও বন্টনের ক্ষেত্রে পেশাদারি সহায়তার প্রয়োজন পড়েছে। এর ফলে যাঁরা এই ধরণের বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশ করে থাকেন তেমন কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে এঁরা নিজেরা জার্নাল প্রকাশ করা আরম্ভ করে।
এরপর যখন ডিজিটালের যুগ এলো তখন এই জার্নালগুলো অনলাইনে পাওয়া যেতে শুরু করল। তবে এই লেখাগুলো কিনে পড়তে হতো তাই অনলাইনেও সেই লেখাগুলো অনলাইনে না কিনলে তা পড়া সম্ভব ছিল না।
দুই শতাব্দী আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান জগতের মানুষজন ভাবতেন যে এ সব বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাগুলো যেন সবাই পড়তে পারেন এবং তা পড়তে হলে কিনে পড়ার প্রয়োজন নেই ঠিক যেমন পাবলিক 'লাইব্রেরি অফ সাইন্স' (পিএলওএস) জার্নালটির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
এই পদ্ধতিতে পাঠককে নির্দিষ্ট কোনও লেখা পড়তে বা পর্যালোচনা করতে হয়তো সেই লেখাটি কিনে পড়তে হবে না তবে এখানে যিনি নিজের লেখা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক তাঁকে অর্থের বিনিময় লেখাটি প্রকাশ করাতে হবে যাকে প্রসেসিং ফি বলা হয়।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হায়দ্রাবাদের সংস্থা ওএমআইসিএস গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন সংস্থা ফেডারেল ট্রেড কমিশন গবেষকদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য মামলা করে (ছবি সৌজন্যে ওএমআইসিএস ওয়েবসাইট)
যদিও এখন কিছু সংখক অসাধু প্রকাশক কোনও রকম সম্পাদকীয় বা নৈতিক মূল্যমান না রেখে একটা মোটা টাকার অংকের বিনিময় লেখা প্রকাশ করছেন। যার ফলে এই পদ্ধতিটির অপব্যবহার হচ্ছে।
এর ফলে কিছু সংখক নিম্ন মানের গবেষক তাঁদের লেখা প্রকাশ করাবার জন্য এই ধরণের বিভিন্ন জার্নালের ব্যবহার করছেন।
এর ফলেই ভিত্তিহীন বিজ্ঞানের বাজার আরও রমরমিয়ে বেড়ে চলেছে।
এই ধরণের ভিত্তিহীন প্রচুর লেখা ও রিসার্চ পেপার যে সব জার্নালে প্রকাশিত হয় সেই সব জার্নার ভারত, চীন, তুর্কি এমনকি আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধরণের হাজার হাজার জার্নাল বাজারে ছেয়ে গেছে।
এখন যে কোনও বৈজ্ঞানিক এই ধরণের বহু সস্তা জার্নালে যে কোনও মানের লেখা বা রিসার্চ পেপার খুব সহজেই প্রকাশ করাতে পারে।
বেশ কিছু বছর আগে 'সাইন্স' নামক জার্নালটির কয়েকজন সাংবাদিক তাঁদের আসল পরিচয় গোপন রেখে একটি কাল্পনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি করে রিসার্চের কয়েকটি তথ্য প্রকাশ করিয়েছিলেন। এই তথ্যগুলোও ছিল কাল্পনিক।
এমনকি এক অস্ট্রেলিয়ান অধ্যাপক তার ছেলের একটি লেখা রচনা যেটা সে তার স্কুলে লিখেছিল তাও প্রকাশ করার জন্য পাঠান এবং সেই লেখাটিও প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়।
আবার বহু গবেষক জেনেশুনে এই ধরণের সস্তা জার্নালে নিজেদের লেখা প্রকাশ করান।
একজন গবেষক মোট কতগুলো রিসার্চ পেপার প্রকাশ করিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করে ভারতীয় গবেষকদের কাজের নিয়োগ করা হয়, পদোন্নতি হয় এবং কেতাবি মহলে পরিচিতিও হয়।
পদ্ধতিতে বোধহয় এখন বদলের প্রয়োজন। ভিত্তিহীন রিসার্চ পেপার ভুয়ো ও ভিত্তিহীন বিজ্ঞান চর্চার সৃষ্টি করবে যার ফলে ভিত্তিহীন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংগঠন, অর্থায়ন সংস্থা, বিভিন্ন শিক্ষা সংস্থা ও পেশাদারি সংস্থাগুলোকে এমন ভিত্তিহীন জার্নালের বিরোধিতা করতে হবে। ভিত্তিহীন বিজ্ঞান চর্চাকে রুখতে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত।
(সৌজন্যে মেল টুডে)
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন