মাত্র ১১ বছরেই সৈনিক, কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের গুপ্তচর হিসাবেও
কখনও লড়াই করেছেন, কখনও পাগল সেজে শত্রুশিবিরের খবর এনেছেন
- Total Shares
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত একটি নাম তারামন বিবি। একটি বীরত্বপূর্ণ নাম। একই সঙ্গে একটি ইতিহাস। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে কাজ করেছেন নানা ভূমিকায়। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করে। বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন চলে গেলেন দেশের বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। তাঁর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল জাতির। তারামন বিবির জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাছারিপাড়ায়। তাঁর বাবা আবদুস সোবহান এবং মা কুলসুম বিবি। তাঁর স্বামী আবদুল মজিদ। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
মুক্তিযুদ্ধে তারামন
১৯৭১ সাল। তখন তারামনের বয়স ছিলো ১৪ বছর। তারামন বিবি ১১ নম্বর সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শঙ্কর মাধবপুরে ছিলেন। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার প্রস্তাব দেন। প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এতে রাজি হননি। পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্মকন্যা হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপরই তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তাঁর মা।
মহিলা মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি [সৌজন্যে: লেখক]
তারামন বিবির সৈনিক হয়ে ওঠার গল্প অবাক করার মতোই। তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান।
একদিন সরাসরি যুদ্ধের ঘটনা -- ঠিক মধ্য দুপুর, সবাই খেতে বসেছে। পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য তারামনকে বলা হল। তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাঁদের দিকে আসছে। সবার খাওয়া বন্ধ, দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই। তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন।
শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়, নানা কৌশলে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে সোজা চলে গেছেন পাক বাহিনীর শিবিরে। কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন। চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন। কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী ধরে।
আর জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। এমনই এক ঘটনা গণমাধ্যমে আসে তারামনের ভাষ্যে। পাকবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী তারামন। ১২ বছর বয়সী তারামনের সারা শরীরে কাদা, পাগল সেজে পাকক্যাম্পে এসেছে সে। পাকসেনারা তারামনকে আদতেই পাগল ভেবে নানান অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিল, মজাও পাচ্ছিল ঢের। তারামন ঘুরে ঘুরে পাকি ক্যাম্পটা পুরোটাই ঘুরে নিলো এসবের মাঝে। ইধার আ, ইধার আ- বলে আসা পাকসেনাকেও বাধা দিলো না সে। চোখ নিবদ্ধ তার ক্যাম্পের পেনেট্রেশন পয়েন্টগুলোর দিকে। ক্যাম্পের কোনদিক থেকে হামলা করলে সহজেই কুপোকাত করা যাবে ওদের সেটাই বের করতে হবে। আরও কিছুক্ষণ পাগলামি করে বের হয়ে আসলো তারামন বিবি। নদীর ওপারে ওঁর সহযোদ্ধাদের ক্যাম্প, ওঁর খবরের জন্য যাঁরা অপেক্ষা করছেন। নদী সাঁতরে পার হলেন তারামন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প উড়িয়ে দিলেন।
স্বাধীনতা পর
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ ২৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন তারামন বিবি। তাঁর নাম ছিল শুধু গেজেটের পাতায়। এখনো কয়েকজন খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায় গেজেটে। কিন্তু তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিভৃত এক পল্লিতে রোগ আর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন চলছিল তারামন বিবির। ১৯৯৫ সালে প্রচারের আলোয় আসেন তিনি। তাঁকে খুঁজে বের করেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমলকান্তি দে। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসিতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীরপ্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ কার কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাঁকে নিয়ে পত্পরত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দেন। তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ নামক একটি বই রয়েছে। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তারামন বিবি।
তারামন বিবির শেষকৃত্য [সৌজন্য: লেখক]
ব্যক্তিগত জীবন
তারামন বিবির পৈতৃক বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার রাজীবপুরের কাচারিপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম আবদুস সোহবান। মা কুলসুম বিবি। স্বামী আবদুল মজিদ। তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ২০১৮ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থায় ভুগছিলেন। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ২০১৮ এর ১ তারিখে তিনি নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাছারিপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
তারামনকে ভুলবে না জাতি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব প্রাপ্ত দু’জন নারীর মধ্যে একজন তারামন বিবি। এ বছর বিজয়ের মাসের প্রথম দিন এই বীর যোদ্ধাকে হারাল বাংলাদেশ। তারামন বিবি দেশকে স্বাধীন করে আজ দেশের বুকেই শেষ নিদ্রায় শায়িত হলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তারামন বিবি অস্ত্র হাতে নিয়ে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁর সেই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতি এবং স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ চিরকাল তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে মহান এই মানবীকে।