সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নতুন করে সুরক্ষিত হয়েছে নারীর অধিকার
অধিকারের জন্য এখনও আদালতের উপরে ভরসা করতে হয় মহিলাদের
- Total Shares
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের কয়েক দশক পুরোনো পক্ষপাতিত্ব লোপ করতে সুপ্রিম কোর্ট ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় একটি রায় দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, জন্ম যবেই হোক না কেন, এবার থেকে পরিবারের মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির সমপরিমাণ ভাগ পাবেন। পিতামহের সম্পত্তিতে তাঁর পিসিদের কোনও অধিকার নেই, এই আর্জি জানিয়ে জনৈক ব্যক্তি আদালতে মামলাটি করেছিলেন।
বিচারপতি এ কে সিক্রি ও বিচারপতি অশোক ভূষণের বেঞ্চ জানায় যে ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনকে ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়েছিল এবং এই সংশোধনের পরে এখন আইন অনুযায়ী পরিবারের মহিলারাও পরিবারের পুরুষদের মতো পৈতৃক সম্পত্তির সমান অধিকার ভোগ করবেন।
উত্তরাধিকার আইন ও সংশোধন
১৯৫৬-এর হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই আইনে পরিবারের মহিলাদের শর্তাধীন ভাবে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু আইন আবার দু'ধরনের - দয়াভাগ ও মিতাক্ষর। পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোতে এবং ওড়িশার কয়েকটি অঞ্চলে দয়াভাগ আইন মেনে সম্পত্তি হস্তান্তর হয়। দেশের বাকি রাজ্যগুলোতে মিতাক্ষর আইন মানা হয়। মিতাক্ষর আইনটির আবার চারটি ধরন রয়েছে - বেনারস, মিথিলা, মৌক্ষ (মুম্বই) ও দ্রাবিড়ীয় (দক্ষিণ)।
মিতাক্ষর ধরনটিতে একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিকে আলাদা করে গণ্য করা হয়। সেই ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি যাঁকে খুশি দিতে পারেন। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকার শুধুমাত্র তাঁর পুত্র সন্তানরাই পাবেন। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া, তাঁর কন্যারা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে শুধুমাত্র তাঁর ভাগের উত্তরাধিকার লাভ করতে পারবেন। কিন্তু মহিলারা কোনও ভাবেই পূর্বজদের সম্পত্তির শরিক হতে পারবেন না। মহিলারা খুব বেশি হলে পিতার সম্পত্তি থেকে তাঁদের ভাত-কাপড়ের দাবি করতে পারেন।
২০০৫ সালের সংশোধনের ফলে এই আইনের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু বিভিন্ন আদালত এই আইনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের রায় দেওয়ায় এই সংশোধন নিয়ে এখনও প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে।
বিভ্রান্তির সৃষ্টি
বোম্বাই হাইকোর্ট জানিয়েছিল যে, মহিলারা আইন সংশোধনের পরে জন্মেছেন (অর্থাৎ, ২০০৫ এর পরে) শুধুমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রে এই নতুন পরিবর্তন (অর্থাৎ মহিলারা পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার পাবেন) প্রযোজ্য। অন্যদিকে, দিল্লি, কর্ণাটক ও ওড়িশার হাইকোর্টগুলো জানিয়েছে যে মহিলারা ২০০৫ সাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন প্রযোজ্য।
২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, যদি কেউ সংশোধনের আগে মারা গিয়ে থাকেন তা হলে তাঁর কন্যারা পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পাবেন না। সুপ্রিম কোর্টের এই নতুন রায়ে আবার বলা হচ্ছে যে, ২০০৫ সালের আগের সম্পত্তি বিভাজন নিয়ে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোতেও মহিলারা সম্পত্তির অধিকার লাভ করতে পারবেন। এমনকি, যদি কোনও মহিলা ২০০৫ সালের আগে মারা যান, তা হলে তাঁর সন্তানরাও মায়ের দিকের সম্পত্তির শরিক হবেন।
সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি যে মামলাটির রায় দিল তাতে মামলাকারী দুটি কারণ দেখিয়ে মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তির উপর অধিকার নেই বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। মামলাকারী অমর জানিয়েছিলেন যে, তার পিসিরা যেহেতু ১৯৫৬ র আগে জন্মেছেন তাই তাদের ক্ষেত্রে ১৯৫৬ র উত্তরাধিকার আইন বা ২০০৫ এর সংশোধন প্রযোজ্য নয়। এর আগে নিম্ন আদালত এবং হাইকোর্টও তাঁর এই আর্জিতে সায় দিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আর্জি খারিজ করে দেয়।
সুপ্রিম কোর্টে মহিলাদের স্বস্তি
সম্প্রতিকালে এই নিয়ে তিন বার সুপ্রিম কোর্ট নারী অধিকার রক্ষার পক্ষে রায়দান করল। ২০১৭ সালের অগস্টে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, তিন তালাক অবৈধ। এ বছরের শুরুতেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাদিয়া মামলায় জানিয়েছে যে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলারা যদি নিজের ইচ্ছায় বিবাহ করেন তা হলে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা চলবে না।
সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকাকে কুর্নিশ জানিয়েই বলছি, বিষয়টি খুব দুর্ভাগ্যজনক যে এখনও আমাদের দেশে মহিলাদের অধিকার রক্ষার জন্যে একেবারে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। প্রত্যেক মহিলার কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে আইনি যুদ্ধ চালাবার ক্ষমতা নেই। তাই অনেক মহিলাকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে মেনে নিতে হয় যা তাঁদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
কৃষি জমি
কৃষি জমির উত্তরাধিকারেও এখন শুধুমাত্র পুরুষদের অধিকার। কৃষিজমির উত্তরাধিকার আইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের কৃষিজমির উত্তারিধকারী হতে দেওয়া হয় না। অজুহাত দেখান হয় যে, মহিলারা উত্তরাধিকার সূত্রে যদি জমির ভাগ পান তাহলে সেই জমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
হিসাব কষে করে দেখা গিয়েছে যে দেশের মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষিজমির মালিকানা মহিলাদের। তাও এমন একটা সময় যখন বাড়ির পুরুষরা রুজি রোজগারের সন্ধানে শহরে পাড়ি দিচ্ছেন এবং মহিলারা চাষবাস সামলাচ্ছেন। জমির মালিকানা তাঁদের নামে না হলে তাঁরা কৃষি ঋণ পাবেন না বা সরকারি প্রকল্পে ভর্তুকি দরে বীজ ও কীটনাশক কিনতে পারবেন না।
১৯৫৬ সালের আইনের ৪(২) ধারায় কৃষি জমিকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। ২০০৫ সালে সংশোধনের সময় এই ধারাটিকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানিয়েছিল, "কৃষিজমি একান্ত ভাবে রাজ্যের বিষয় এবং এই বিষয় কোনো আইন প্রণয়নের অধিকার সংসদের নেই। তাই ৪(২) ধারা নাকচ হয়ে যাওয়ার পরেও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন কৃষি জমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।"
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তাতেও কৃষি জমির কোনও উল্লেখ নেই। খবরের প্রকাশ, আইন থাকা সত্বেও এখনও মহিলাদের দিয়ে জোর করে সই করিয়ে নেওয়া হয় যে তাঁরা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি চান না। আশা করা যায়, সুপ্রিম কোর্টের এই নতুন রায় মহিলাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করবে।