রেললাইনের উপরের একটি ব্রিজ কী ভাবে একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিল?
দোকান-পাট, বাজার-হাট নিয়ে এ এক বধিষ্ণু এলাকা, এখন দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত অঞ্চল সন্তোষপুর
- Total Shares
ষাটের দশকের কথা। বাংলায় তখন কংগ্রেস সরকার। দক্ষিণ শহরতলীর যাদবপুর রেললাইন ঘেষা সন্তোষপুরে একটি জন বসতি গড়ে উঠছে। তখনকার সন্তোষপুর যাদবপুর রেললাইন থেকে শুরু করে শুধমাত্র জোড়া ব্রিজের আগে অবধি বিস্তৃত ছিল। সেই সময় জোড়া ব্রিজ বলতে আমরা পাশাপাশি দুটি বাঁশের সাঁকো বুঝতাম। যাতায়াতের সমস্যা ছিল বিস্তর। বলতে গেলে, প্রতিদিনই আমাদের যাদবপুর অবধি হেটে যাতায়াত করতে হতো।
৬৭ সালে প্রথমবার এই সমস্যার কিছুটা সুরাহা হল। সেই বছরেই, তৎকালীন অঞ্চলের এক রাজনৈতিক নেতার উদ্যোগে প্রথমবারের জন্য রেললাইন পেরিয়ে যাত্রীবাহী বাস পরিসেবা চালু হল সন্তোষপুরে। যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে এখন যেখানে মিনিবাস স্ট্যান্ড, অর্থাৎ ফিফ্থ রোডের মধ্যে চলাচল করত দুটি বাস। এদের একটি নাম ছিল যাত্রীতোষ, অন্যটির পান্থতোষ। ভাড়া এক পয়সা। সেই বেশ সময় বেশ কয়েকবার এই বাসে যাতায়াত করতে গিয়ে দেখেছি অনেক সময়তেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত। যতক্ষণ বাসের জন্যে অপেক্ষা করতাম ততক্ষনে কিন্তু স্বচ্ছন্দে ৮বি পৌছিয়ে যাওয়া যেত।
৪০ বছর পর, মানে ২০১৮ সালের, সন্তোষপুরকে চেনা দায়ে। যাদবপুর থেকে অনবরত অটো, তাও আবার একাধিক রুটের। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বাস রুট। তার মধ্যে কয়েকটি আবার শীততাপনিয়ন্ত্রিত। রাস্তার দু'ধারে একের পর এক পাকা বাড়ি এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। দোকান-পাট, বাজার-হাট নিয়ে সব মিলিয়ে এক জমজমাট বধিষ্ণু এলাকা। জমি বা ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত অঞ্চলের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে সন্তোষপুর।
সন্তোষপুর এখন অনেক বেশি জমজমাট, অভিজাত
সন্তোষপুরের এই পট পরিবর্তনের পিছনে মূলত দুটি কারণ। ১৯৮০ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপালিটি হল সন্তোষপুর। এর ঠিক পাঁচ বছরের মধ্যে কলকাতা পুরসভার অধীনে নিয়ে আসা হল এই অঞ্চলটিকে। বর্তমানে সন্তোষপুরের বিস্তৃত অংশই কলকাতা পুরসভার ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত।
বলা যেতেই পারে আশির দশকের মাঝামাঝি, অর্থাৎ কলকাতা পুরসভার অধীনে চলে আসার পর থেকেই, সন্তোষপুরের উন্নয়ন যজ্ঞ শুরু হয়েছিল। সেই সময় এলাকার এলাকার ৮৪টি ক্লাবকে একত্রিত করে আন্তঃ সঙ্ঘ সম্মিলনী স্থাপন করেন পরিমল চক্রবর্তী ও কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। বিভিন্ন ধরণের সামাজিকমূলক কাজকর্ম করত এই সংস্থা। এই সংস্থাটির উৎসব কমিটির দায়িত্বে ছিলেন লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতা পুরসভা ও ও সংস্থাটির যৌথ উদ্যোগে তখন এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, নল নিকাশি ব্যবস্থা ও অন্যান্য পরিকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হতে লাগল। আজকের সন্তোষপুরের 'অভিজাত' হয়ে ওঠার পিছনেও এই সংস্থাটির অনেকটাই অবদান।
এই সংস্থাটির তরফ থেকে ১৯৮৭ সালে প্রথম দাবি তোলা হয়েছিল পালবাজার লেভেল ক্রসিংয়ের উপর একটি ব্রিজ তৈরি করার। জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল গাড়ি-ঘোড়া। যাদবপুর স্টেশন থেকে ট্রেন বেরোলে বা স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করার সময় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হত পালবাজার লেভেল ক্রসিং সংলগ্ন অঞ্চলে। এই সংস্থাটির দাবি মেনে ১৯৮৯ সালে সুকান্ত সেতুর কাজ শুরু হল। ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রী সাধারণের জন্যে চালু করে দেওয়া হল এই সেতু।
আর, এর ওপর থেকেই সন্তোষপুরকে চেনা দায়। একদিকে বাইপাস অন্যদিকে যাদবপুর। যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। জমির দাম আকাশ ছোঁয়া হল। শেষ তিরিশ বছরে প্রচুর বাইরের লোক (কলকাতার অন্যান্য অঞ্চল বা মফস্বল থেকে) এখানে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করল। বলতে গেলে এই সুকান্ত সেতু সন্তোষপুরের লাইফলাইন হয়ে উঠল।
সত্যি ভাবতে অবাক লাগে যে রেললাইনের লেভেলক্রসিংয়ের উপর দিয়ে একটি ব্রিজ কী ভাবে একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা বদলে দিতে পারে!