দেশের পরিবহণ ব্যবস্থার সংস্কারে ঢাকায় আন্দোলনে পড়ুয়ারা
মন্ত্রী-আমলা-বিচারপতিদের গাড়ির চালকের লাইসেন্স দেখছে পড়ুয়ারা
- Total Shares
সামনে রাস্তা বন্ধ! রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বার শাহবাগে এমন একটি প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে এক শিক্ষার্থী।
ঢাকায় চলছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বাসে পিষ্ট হয়ে দুই পড়ুয়ার মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২৯ জুলাই হঠাৎই নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় যে শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে রপ নিয়েছে। শনিবার এই আন্দোলন সাত দিনে।
বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত, অনিয়ন্ত্রিত ও ভয়ঙ্কর বলে অভিযোগ। দশকের পর দশক ধরে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের হাতে কার্যত বন্দি যাত্রীরা। এই ক্ষেত্রটি এতই প্রভাবশালী যে রাষ্ট্রকাঠামোও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন বাংলাদেশে যেমন নতুন নয়, তেমনই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে পরিবহণ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বিরোধী প্রতিবাদ দেখা দিলেও তাও কখনও হালে পানি পায়নি। তবে এ বার ব্যতিক্রম। সড়ক পরিবহণ নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এত বছর ধরে আন্দোলন করে কাজের কাজ কিছু করতে না পারলেও, স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের আন্দোলন সাড়া ফেলেছে দেশের বাইরেও।
কেন এই আন্দোলন?
আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, নিজেদের নাগরিক বোধ থেকেই এ ধরণের উদ্যোগে উৎসাহী হয়েছেন তাঁরা।
তাঁদের দাবি, সব বাস-ট্রাক ড্রাইভারের লাইসেন্স থাকতে হবে, এটিই তাঁদের মূল দাবি। লাইসেন্সধারী চালকদের দুর্ঘটনার হার বেশ কম। দুর্ঘটনার মূল কারণ লাইসেন্সহীন চালকরা। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, বাস-ট্রাকের মালিকরা খরচ কমানোর জন্য অদক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক লাইসেন্সহীন চালক, হেল্পার দিয়ে বাস চালান। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল, চালকদের লাইসেন্স থাকা নিশ্চিত করা
নয় দফা দাবি
বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ চালিয়ে আসছেন। তাঁদের দাবি, বেপরোয়া চালকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন বদল করতে হবে, নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার বসাতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, দেশের সর্বত্র শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে, চলাচলের অনুপযুক্ত গাড়ি পথে নামবে না এবং লাইসেন্সবিহীন কেউ গাড়ি চালাতে পারবেন না প্রভৃতি।
আন্দোলনে অচল রাজধানী
প্রথম দিকে কিছুটা হিংসা থাকলে এখন অহিংস আন্দোলন চলছে। আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে।
ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্ররা পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গাড়ি থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স দেখতে চাইছেন পুলিশের সামনেই। লাইসেন্স দেখাতে না পারলে গাড়ির চাবি আটকে রাখছে তারা।
উল্টো পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের গাড়ি শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে। তোপের মুখে পড়েন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কয়েকজন সাংসদ, বিচারপতি ও সচিব-সহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীরা।
ঢাকার রাস্তায় গণ পরিবহণ খুবই কম। এর মধ্যে সকালে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হলে বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়া যানবাহনের জট দেখা গেলেও দুপুরের পর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়।
আন্দোলনকারীরা অ্যাম্বুলেন্স ও হজযাত্রীদের গাড়িকে ছাড় দিলেও চলতি পথে যানবাহন না পেয়ে সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
বাস মালিকদের পাল্টা চাল
নিরাপদ সড়কের দাবিতে এ বার পাল্টা বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকার আন্তঃজেলা টার্মিনালগুলো থেকে বাস ছাড়া বন্ধ। এ ছাড়া কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে গণপরিবহণগুলোও বন্ধ রয়েছে। বাস মালিকরা বলছেন, সড়কে ছাত্রদের ভাঙচুরের কারণে পরিবহণ শ্রমিকরা বাস চালাতে চাইছেন না। এমন অভিযোগের ভিত্তি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই প্রায়ই ধর্মঘট ডেকে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছেন পরিবহণ শ্রমিক-মালিকরা।
কেউ অপরাধ করলে তাকে কি শাস্তি দেওয়া যাবে না? শাস্তি দিলে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে তা থেকে ফায়দা নেয়া হবে? পরিবহণ শ্রমিকরা এই ঔদ্ধত্য ও সাহস কোথায় পান? আইন-আদালত-প্রশাসনকে অবজ্ঞা করে চালিত পরিবহণ ব্যবস্থার বিরূপ প্রভার এখন থেকেই পড়ছে পরিবহণ ব্যবস্থায়। এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে।
প্রতিবাদ জানানো অধিকার, কিন্তু তার জেরে মানুষ দুর্ভোগে পড়লে মুশকিল। প্রতিবাদের নামে ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষকে এভাবে দুর্ভোগে ফেলে সারা দেশের সঙ্গে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা ঠিক নয়।
আন্দোলন যাই হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুগতে হয় যাত্রীদের। যে কোনও ধরনের আন্দোলনেই ভুগতে হয় যাত্রীদের। প্রতিবাদের নামে অরাজক অবস্থা তৈরি করলে পরিবহণ মালিকদের শাস্তি দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। আন্দোলনে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এজন্য পরিবহণ মালিকরা তাদের দায়ী করছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি, নাশকতা তারা করেনি।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
দুই পড়ুয়া নিহত হওয়ার পর ঢাকার রাস্তায় শুরু হয়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। প্রথম তিন দিনে এই আন্দোলনে জঙ্গিপনা থাকলেও এখন শান্তিপূর্ণ ভাবে আন্দোলন হচ্ছে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ বন্ধ। ছাত্ররা চালকদের বৈধতা পরীক্ষা করছেন, তা সেই চালক মন্ত্রী-আমলা-বিচারপতি যাঁরই গাড়ির হোন না কেন। রাস্তার ভুল দিক দিয়ে যাওয়া মন্ত্রীর গাড়িকে ঘুরিয়ে নির্ধারিত পথে নিয়ে যেতে বাধ্য করছেন ছাত্ররা। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন পাচ্ছেন পড়ুয়ারা। আন্দোলন একেবারে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের রূপ পেয়েছে।
অচলাবস্থার অবসান চাই
ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল, চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো প্রঊৃতি কারণে গণপরিবহণ এখন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তবু গাড়ি ভাঙচুর করা কোনও সুষ্ঠু সমাধানের পথ হতে পারে না। আবার ছাত্র আন্দোলনও এথনও ছাত্রদেপর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তারা বিভিন্ন মহল থেকে উস্কানি পাচ্ছে বলে অভিযোগ। ছাত্রদেরও এই উস্কানিতে প্রভাবিত হলে চলবে না।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং সড়ক নিরাপদ করতে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের বাস্তবায়ন জরুরি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে সে দিকে তাদের নজর দিতে হবে। অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হতে হবে দেশের সরকারকেই।