বনদপ্তর লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় সমস্যায় দেড় লক্ষ মৎস্যজীবী
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস সার, লাইসেন্সে অনীহা বনদপ্তর ও ব্যাঘ্র প্রকল্পের
- Total Shares
রাজ্যের মৎস্য দপ্তর, এমনকী কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে লাইসেন্স পেলেও বনদপ্তর ও সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের থেকে লাইসেন্স না পাওয়ায় সুন্দরবনে অন্তত দেড় লক্ষ মৎস্যজীবী সমস্যায় পড়েছেন। পঞ্চায়েত ভোটের দু-মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী বলার এক সপ্তাহের মধ্যে সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করেন জেলাশাসক। কিন্তু তাতেও সমস্যা রয়ে গেছে সেই তিমিরেই।
সুন্দরবনের কোর এরিয়া বা গভীর অরণ্য, অর্থাৎ গোসাবা কুলতলি প্রভৃতি এলাকায় নদীর যে খাঁড়ি রয়েছে, তার কাছাকাছি যাঁরা থাকেন, মোটামুটি ভাবে তাঁরা সকলেই মৎস্যজীবী। তবে তাঁদের প্রায় সকলেরই ছোট ছোট নৌকা, যেগুলিকে স্থানীয় ভাবে আমরা ক্রান্তি বলে থাকি। এই সব ছোট নৌকা নিয়ে তাঁরা কেউ সমুদ্রে যেতে পারেন না। তাঁরা মূলত মাছ ধরতে যান পালতোলা, দাঁড়-টানা নৌকায় করে। মাছও ধরেন নদী ও খাঁড়ি এলাকায়। কারও কারও ছোট যন্ত্রচালিত নৌকাও অবশ্য আছে, এগুলিকে স্থানীয় ভাবে ওয়ান সিলিন্ডার নৌকা বলা হয়।
এই অঞ্চলে প্রবেশের জন্য বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দিয়ে থাকে বনদপ্তর। বামফ্রন্ট সরকারের সময় খুব অল্প সংখ্যায় এই লাইলেন্স দেওয়া হয়েছিল। খুব সম্ভবত তিনশো থেকে চারশো বিএলসি দেওয়া হয়েছিল, যা এই এেলাকার মৎস্যজীবাদের সংখ্যার তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। এই সংখ্যা বাড়ানো উচিৎ বলে আমরা বারে বারে আবেদন করেছি।
এখন বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র যাঁদের বিএলসি আছে, তাঁরাই এই সব এলকায় মাছ ধরতে পারবেন। আমরা বারে বন দপ্তর ও ব্যাঘ্র প্রকল্পেরর আধিকারিকদের অনুরোধ করার পরেও এই দুই দপ্তেরর কেউই নতুন করে বিলএসি দিতে রাজি হচ্ছে না। তাতে সমস্যা হচ্ছে মৎস্যজীবীদের। নতুন করে লাইসেন্স না দিয়ে এই দুই দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে, যাঁদের পুরোনো বিলএসি আছে, শুধুমাত্র তাঁরাই এই এলাকায় মাছ ধরতে পারবেন। তা হলে অন্যদের রোজগারের উপায় কী হবে?
এই অঞ্চলে প্রবেশের জন্য বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দিয়ে থাকে বনদপ্তর
যাঁরা এই সব অঞ্চলে মাছ ধরতে যান, তাঁরা অবশ্যই মৎস্য দপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর অফ ফিসারিজ (মেরিন, ডায়মন্ড হারবার) থেকে আমাদের মাছ ধরার লাইসেন্স দেওয়া হয়। যাঁরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, তাঁরা একটু বড় ট্রলার নিয়ে যান, তাঁদেরও লাইসেন্স দেয় এই একই প্রতিষ্ঠান।
আমাদের যুক্তি হল, এঁরা সত্যিই মাছ ধরতে যান কিনা, তার তো প্রমাণ হল মৎস্য দপ্তরের লাইসেন্স। আমাদের আবেদন, যত দিন না বনদপ্তর লাইসেন্স দিতে পারছে, ততদিন আমাদের কাছে থাকা মৎস্য দপ্তরের লাইসেন্সের মান্যতা দেওয়া হোক, ও অন্য লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা শিথিল করা হোক। কিন্তু কোনওটিই না করে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, তাঁদের জাল তুলে নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মাছ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরেই এই অত্যাচার চলছে।
এই অত্যাচারের কথা আমরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানিয়েছিলাম। পঞ্চায়েত ভোটের দু-মাস আগে গোসাবায় একটি সভায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্থানীয় বিধায়কদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। মৎস্যজীবীদের এই সমস্যার কথা তিনি উপলব্ধিও করেছেন। ওই সভায় বনদপ্তরের সচিবও ছিলেন। আমাদের ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁকেও আগেই এ ব্যাপারে জানানো হয়েছিল। ওই বৈঠকেই জেলাশাসক, সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী ও বনদপ্তরের সচিবকে তিনি মৎস্যজীবীদের এই সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার কথা বলেন।
মুখ্যমন্ত্রী বলার এক সপ্তাহের মধ্যেই জেলাশাসক সবকটি মৎস্যজীবী সংগঠনকে, বনদপ্তর ও ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকদের ডাকেন। সেই বৈঠকে আমাদের সমস্যার কথা আমাদের কাছ থেকেই শোনেন জেলাশাসক। বনদপ্তর ও ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকদের থেকেও তাঁদের বক্তব্য শোনেন। পরে বলেন যে, তাঁরা সব পক্ষের বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছেন, তাঁর মাধ্যমেই সমাধান হবে। এখনও পর্যন্ত আমাদের সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি।আমরা নতুন করে কিছু চাইছি না, আমরা বলছি, মৎস্যদপ্তরের লাইসেন্সের ভিত্তিতে আমাদের বিএলসি দেওয়া হোক।
সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি ও এই অঞ্চলের উপর দেড় লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল
উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য মৎস্যদপ্তর আমাদের লাইসেন্স দেয়। তার পরে ২০০ মাইল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার লাইসেন্স দেয়। তার পরে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বা ইইজেড। সেখানে বিদেশি ট্রলারও মাছ ধরতে পারে। আমাদের ওখানে যাওয়ার দরকার হয় না।
১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত তেমন মাছ থাকে না। এর বাইরে যাওয়ার জন্য আমাদের এমপিইডিএ বা কেন্দ্রীয় সরকারের মেরিন প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি লাইসেন্স দেয়। এই লাইলেন্সের জন্য আমরা আবেদন করেছিলাম, কিছু পেয়েওছি। কেন্দ্রীয় সরকার ধীরে ধীরে এই লাইসেন্স দিচ্ছে। এ জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হয়। কোনও সমস্যার জন্য এক বছর লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ ছিল, আবার দেওয়া শুরু হয়েছে, আমরাও পেতে শুরু করেছি।
কিন্তু এই দুই লাইসেন্স পাওয়ার পরেও বনদপ্তরের লাইসেন্সের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে না, তার কারণ এদের একটি কোর এরিয়া রয়েছে, যেখানে মানুষ বসবাস করে না। এই সব এলাকায় নদী-খাঁড়িতে ঢুকতে গেলে বনদপ্তর ও টাইগার রিজার্ভের অনুমতি প্রয়োজন। তা ছাড়া যে সব ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, তাদেও যেতে হয় ওই এলাকার উপর দিয়েই। তাই আমাদের দাবি, এখান দিয়ে যাতায়াতের জন্য আমাদের লাইসেন্স দেওয়া হোক। কিন্তু বারে বারেই তাঁরা আমাদের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। লাইসেন্স না থাকায় ওই এলাকার উপর দিয়ে আমরা বেআইনি ভাবেই যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছি আর বনদপ্তর এবং টাইগার রিজার্ভের আধিকারিকরা মৎস্যজীবীদের আটক করছেন, সমস্যা তৈরি করছেন।তা ছাড়া এই সব এলাকায় ছোট নৌকাগুলো মাছ ধরে, যারা সমুদ্রে যেতে পারে না। সেটারও তো প্রয়োজন আছে। সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি ও এই অঞ্চলের উপর দেড় লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল। মাছ ধরা ছাড়াও তাঁরা কাঠ ও মধু সংগ্রহেও গভীর জঙ্গলে যান। লাইসেন্স দরকার তাঁদেরও।