অনাহারে তিন শিশুকন্যার মৃত্যু দেখিয়ে দিল এ দেশে শিশুদের চেয়ে ইঁদুরের অবস্থা ভালো
মাঠে ও হিমঘরের বাইরে পচছে শস্য, ওদের পাকস্থলিতে এককণা খাবার পেলেন না ডাক্তাররা
- Total Shares
ওয়ার্লড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে যা জনসংখ্যা তার জন্য প্রতি বছর ২২.৫ কোটি থেকে ২৩ কোটি টন করে খাদ্য প্রয়োজন। ২০১৬-১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী উৎপাদন ২৭.৩৩৮ কোটি টনে পৌঁছেছে।
বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়নশীল অর্থনীতি বলে যে দেশ গর্ব করে থাকে, যে দেশের খাদ্য উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা, সেই দেশের রাজধানী শহরেই তিনটি ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু হল অনাহারে, এক জনের বয়স আট বছর, এক জনের চার বছর ও অন্য একজনের বয়স দু-বছর।
এই তিন শিশুর পাকস্থলিতে খাবারের কণামাত্র পাওয়া যায়নি (ছবি -- টুইটার)
যে চিকিৎসাকরা তাদের ময়নাতদন্ত করেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন যে ওই তিনটি ছোট মেয়ে মারা গিয়েছে কারণ তারা বেশ কয়েকদিন যাবৎ কিছুই খায়নি। তিনি বলেন, “ওই তিন কন্যার পাকস্থলিতে খাবারের কোনও কণা পাওয়া যায়নি।”
স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই দিল্লি সরকার এই মামলায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে এই যে নানা ধারনের তদন্ত হয়, মানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত, পুলিশি তদন্ত, বিভাগীয় তদন্ত, উচ্চপর্যায়ের তদন্ত, উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত – এ সবই চমক ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঘুরিয়ে বলতে গেলে কার ঘাড়ে দোষ চাপানো যাবে, তা স্থির করা।
রিপোর্টে হয়তো দেখা যাবে যে ওঁদের রেশন কার্ড হারিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে ওই পরিবারটি তাঁদের প্রাপ্য রেশনটুকু তুলতেই পারেনি। এমনও উঠে আসতে পারে যে ওই পরিবারটি অন্য রাজ্য থেকে আসায় তাঁদের ঠিকানা সংক্রান্ত প্রামাণ্য নথি ছিল না, তাই রেশন কার্ডের জন্য আবেদনই করতে পারেননি। তবে রিপোর্টে কখনোই একটি বিষয় লেখা হবে না যে খাদ্যের নিশ্চয়তার ব্যাপারে দেশের সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নন, তারা শুধু নির্বাচনে তাদের ভোটের কথাটাই মাথায় রাখে।
কৃষিমন্ত্রী থাকাকালীন শরদ পওয়ার সংসদে বলেছিলেন যে, মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ কৃষিপণ্য নানা ভাবে নষ্ট হয়, সংরক্ষণের অভাবে খোলা জায়গায় পড়ে থেকে ফসল নষ্ট হয়, কখনও পোকা ও ইঁদুরে খায়।
স্বাধীনতার পরে ৭০ বছর কেটে গেছে, চিকিৎসকরা যখন ওই তিন দারিদ্র্যক্লিষ্ট মৃত শিশুর পাকস্থলির ভিতরে খাবারের কণা খুঁজে চলেছেন তখন চাষের মাঠে আর হিমঘরের বাইরে আনাজ ও শস্য পচে নষ্ট হচ্ছে।
এ দেশে শিশুদের চেয়ে ইঁদুরগুলো ঢের ভালো অবস্থায় আছে।
যখনই অনাহারে মৃত্যুর কোনও ঘটনা প্রকাশ্যে আসে তখনই দেশের প্রধান খাদ্যশস্য সংগ্রহকারী সংস্থা ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা এফসিআই-এর দিকে, যাদের ভাঁড়ারে বিপুল পরিমাণে শস্য সঞ্চিত থাকে, অভিযোগের বান ধেয়ে আসে। তবে তাতে অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটে না।
দিল্লির বিজেপির প্রধান মনোজ তিওয়ারি এই ঘটনায় রাজ্য সরকারকে আক্রমণ করে বলেছেন, এটা খুবই ‘দুঃখজনক’ এবং এই ধরনের ‘দুর্ঘটনা’ ঘটেছে দিল্লিতে যে রাজ্যের সরকার দাবি করে যে তারা খাদ্য বণ্টনের ব্যাপারে সেরা হয়েছে। আর দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি দুষছে কেন্দ্রীয় সরকারকে, লোকের বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি না দেওয়ায়।
Politics erupts over death of 3 minor girls in Delhi due to starvation #ITVideoMore videos: https://t.co/Nounxo6IKQ pic.twitter.com/nCisu3IQki
— India Today (@IndiaToday) July 26, 2018
এটা রাজনৈতিক দল আরেকটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তোপ দাগছে, আর সরকার চিরকালই নানা ধরনের প্রস্তাবের কথা শোনায় কারও মৃত্যু ঘটলে। এই ধরনের দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপের জন্য পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র বদলায় না।
সবচেয়ে কারাপ লাগে যখন কারও মৃত্যুর সাক্ষী হয় দেশ। ২০১৭ সালে যখন ঝাড়খণ্ডে সন্তোষী নামে ১১ বছর বয়সী এক বালিকার অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল, তখন সরকার বলেছিল যে অসুস্থতার জন্যই তার মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবার যে অভিযোগ করেছিল, ওই বালিকার মৃত্যুর আগে তারা তার আগে ছ-মাস ধরে কোনও রেশন পাচ্ছিল না, সরকার তার সঙ্গে একমত হয়নি।
এই দেশ ওই একই বছরে আরও একবার ক্ষুধার জন্য মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছিল। দুর্ভাগ্য হল, সে ক্ষেত্রেও মৃত্যুর পরে সেই একই ধরনের কারণ দর্শানো হয়। ৫৮ বছরের সাবিত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় তাঁর অসুস্থতাকেই, যদিও সেই গ্রামবাসী মহিলার রেশখন কার্ড বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। আর তাঁর বাড়িতেও খাবার বলতে কোনও কিছু, হ্যাঁ, কোনও কিচ্ছু ছিল না।
গরিবদের পরিষেবা দেওয়ার সময় সরকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে (রয়টার্স)
যখনই কারও মৃত্যুর খবর শোনে তখনই কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে ওঠে, তাদের ঘুম ভাঙে, এবং কেন দেশে মানুষের অনাহারে মৃত্যু হচ্ছে এবং যে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে সে দেশে কেন কোটি কোটি মানুষ খালি পেটে ঘুমোতে যান, তা নিয়ে তাঁরা গুটিকয় শব্দ খরচ করেন। দেশের ৩৮.৪ শতাংশ শিশুর ঠিকমতো শারীরিক বিকাশ ঘটে না সুষম খাদ্যের অভাবে।
মৃত্যুর সর্বশেষ কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনাহার হয় না, মৃত্যুর কারণ হয় ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া প্রভৃতি, দিল্লির ওই তিন শিশুকন্যার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল। আসলে অনাহারে শিশুরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীরে ন্যূনতম প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না, তাই এই ধরনের রোগে ভুগে তারা মারা যায়।
ওই তিন কন্যার বাবা অস্থায়ী ঠিকাকর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে, তাঁরও মৃত্যু হয়েছে দিল্লিতেই, যার অর্থ হল ওই পরিবারের যে প্রতিদিন খাবার জুটবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। এই শিশুকন্যাদের মায়ের আয়ও নির্দিষ্ট ছিল না। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল, যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে তাদের জন্ম হয়েছিল – এবং পরে মৃত্যুও হয় – তা দরিদ্রদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যত পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
অনাহারক্লিষ্ট দু-বছরের এক শিশুর নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণার প্রতি ঔদাসীন্য ভারতের পক্ষে লজ্জাজনক।
যাঁরা আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এটা তাঁদের ব্যার্থতা।
এটা প্রমাণ করার জন্য আমাদের কোনও বিচারবিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন নেই।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে