স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইটের সুরেলা গুহা, ডুয়ার্সের নতুন গন্তব্য চামুর্চি
উপরি পাওনা ভুটানের দুর্গ ধাঁচের গুম্ফা আর থাঙ্কা
- Total Shares
ডুয়ার্স কি সত্যিই আকর্ষণ হারাচ্ছে? একটা খুট্টিমারি দিয়ে কি পর্যটক ফেরানো যাবে?
ডুয়ার্সের নতুন ডায়গা মানে শুধু খুট্টিমারি, এমন নয়। এ বার চামুর্চি। সঙ্গী নর্থ বেঙ্গল ট্যুরিজমের কমল, সারথিও তিনিই।
- রাজাদা তো গরুমারা গেছেন?
- একাধিক বার।
- রামসাই গেছেন?
- সেটা কোথায়?
- মেদলা ওয়াচ টাওয়ার?
- হুঁ।
- সেখান থেকে আরও খানিকটা দক্ষিণে।
- কী আছে সেখানে?
- চলুনই না। যখন কথা দিয়েছি নতুন কিছু দেখাব তখন চলুন।
- বেশ তবে তাই হোক।
চা বাগানের বুক চিরে ছুটে চলে গাড়ি। আকাশের মুখ ভার। হয়তো দু’-এক পশলা ঢালবে। তবে চলন্ত গাড়ির সঙ্গে অপসৃয়মান প্রকৃতি মন খারাপের সুযোগ দেয় না। মেদলা ওয়াচ টা
ওয়ার থেকে দক্ষিণে চোখ চালালে আন্দাজ মেলে মূর্তি-জলঢাকার সঙ্গমস্থলের। তারও খানিক পরেই জলঢাকা ডায়নার সঙ্গমস্থল। চোখ জুড়নো বিস্তার। দুই নদীর মিলনের আগে মাঝে ঘন ঘাসবন, গরুমারারই অংশ। স্থানীয় ভাষায় কাশিয়ার জঙ্গল। একশৃঙ্গ গণ্ডারের প্রিয় চারণভূমি। প্রকৃতি যেন নিজেই নিজেকে সাজিয়েছে।
হঠাৎ মিহি বৃষ্টি নামে। ইলশেগুঁড়ি। বাদলা বাতাসে এলোমেলো তার চলন। মুখে গায়ে সযত্নে হাত বুলিয়ে যায় সে। বেশ রোম্যান্টিক লাগে। তবে কিছুটা সময় এই নির্জনতা দাবি করে। শুনলাম এখানে সরকারি থাকার ব্যবস্থাও আছে।
- এখানেও তো এক রাত থাকা যেত।
- কী করি দাদা, আপনিই তো যখনই আসেন, ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসেন। কালকেই চলে যাবেন, না হলে...
কথা শেষ করে না কমল। আসলে ছুটি পাওয়াটাই ঝামেলা। অগত্যা মনকে সান্ত্বনা দিই পরের বার আসব বলে।
- আচ্ছা কমল, মূর্তি নদীর অবতরণ দেখেছি রকি আইল্যান্ডে, জলঢাকার বিন্দুতে। ডায়নার অবতরণ দেখা যায় না? কী আছে সেখানে?
- বুলস আই হিট করেছেন দাদা।
- মানে?
- আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সেখানেই। চামুর্চি।
- বাহ, ভারি সুন্দর নাম তো।
- জায়গাটা সম্ভবত তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগবে।
আবার শুরু হয় চলা। চামুর্চি পৌঁছতে যেতে হবে বানারহাট হয়ে। বানারহাট। ছোট্টো জনপদ। কিন্তু সব থেকে মজা হচ্ছে এ জায়গা চা বাগানের মিলনক্ষেত্র। দার্জিলিং, তরাই, ডুয়ার্স মিলিয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার’শ। তবে এগুলি সবই বড় বাগান। উত্তরবঙ্গে ছোট বাগানের সংখ্যা তিরিশ হাজারের কাছাকাছি। এ রকমই বড় বড় তেইশটি চা বাগানের মিলনক্ষেত্র বানারহাট।
বানারহাট ছাড়িয়ে খানিকটা এগতেই সে রকম চা বাগান ঘিরে ধরল আমাদের। তার অনতিদূর পরেই আমরা শাল, জারুলের ঘেরাটোপে। সেটা পার হতেই আবার চা বাগান সামনেই উদ্ধত হিমালয়। যার মাথা আবৃত ঘন কালো মেঘে। পুরো পাহাড়টাই এখানে ভুটানের অংশ। বাঁদিকে বয়ে চলে ডায়না নদী। দেখলেই মনে হয় জলরঙে আঁকা কোনও ক্যানভাস। মনটা ভাল হয়ে যায়। অস্ফুটে কৃতজ্ঞতা জানাই কমলকে। এই সেই চামুর্চি।
চামুর্চিতে এখন হোম-স্টে ছাড়াও থাকার অন্যান্য ভাল ব্যবস্থাও আছে। সেরকমই এক ডেরায় ঠাঁই হল আমাদের। কমল প্রস্তাব দিল চা পানের পর একটু হাইক-এ গেলে কেমন হয়? নেকি অউর পুছ পুছ? এক কথায় প্রস্তাব অনুমোদিত।
ডায়নার এপার ওপার মিলিয়ে চা বাগান ছাড়াও চামুর্চিকে ঘিরে রেখেছে তিনটি অরণ্য। গারুচিরা, কালাপানি আর রোহিতি। জঙ্গলের ছায়া পার করে ডায়নার বুকে পা রাখলাম আমরা। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সঙ্গে নেওয়া হয়েছে আমাদের রিসর্টেরই এক কর্মীকে। স্থানীয় মানুষ। তার সাবধান বাণী। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। হয়তো যে কোনও মুহূর্তে চোখে পড়তে পারে নদী চরে গা এলানো লেপার্ড বা জলে খেলা করা হরিণের পাল। ঝুপ করে সামনে চলে আসতে পারে হাতির দলও। সম্ভাবনার কথা শুনেই শিহরিত। ক্যামারাও তাগ করা আছে। কিন্তু কপালে থাকলে তো। তবে প্রায় কিলোমিটার তিনেক হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের পাদদেশে। অস্বীকার করার উপায় নেই গা ছমছমে এই চলন পথে প্রকৃতি একেবারে উপুড় করে দিয়েছে তার আশীর্বাদ। এবার খানিক চড়াইয়ের পালা। সঙ্গে যখন স্থানীয় পথপ্রদর্শক রয়েছেন নো চিন্তা, ডু ফূর্তি। খানিকটা ওঠার পর মিলল এক গুহামুখ। স্থানীয়দের ভাষায় চামুর্চি মহাকাল। দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করেন স্থানীয় মানুষ। শিবরাত্রীর দিন ভিড় উপচে পড়ে।
গুহামধ্যে কোনও কোনও স্থানে লাভা, খনিজ, কাদা বালি জাতীয় জিনিষ জমতে জমতে আপন খেয়ালে সৃষ্ট ঢিপি বা দণ্ডসম ভৌগলিক চমৎকারকেই বলে স্ট্যালাগমাইট। সাধারণত গুহার উপর থেকে চুঁইয়ে পড়েই এর সৃষ্টি। জয়ন্তীতেও আছে এরকম মহাকালের মন্দির। আকৃতিগত কারণে স্ট্যালাগমাইট গুলিকে অনেক সময়ই শিবলিঙ্গের মতো দেখতে হয়। এরই ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ গুহার ছাদ থেকে জমতে জমতে নেমে আসা ভৌগোলিক চমৎকারকে বলে স্ট্যালাকটাইট। দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয় অনবদ্য সৌন্দর্য্য। যে প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের সামনে মাথা নত করতেই হবে।
মহাকালের গুহায় পৌঁছে তাই মুগ্ধতা গ্রাস করল। আমাদের পথপ্রদর্শক একটা পাথর নিয়ে গুহার মধ্যেই মন্দিরের অন্য প্রান্তে ছুড়ে দিল। স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইটে ধাক্কা খেয়ে সৃষ্টি হল সুরেলা শব্দের। শুনলাম এই কারণে এই গুহাকে মিউজিক্যাল স্টোন কেভ বা বা পাথরের সুরেলা গুহা নামেও ডাকা হয়।
প্রকৃতির বিস্ময় দেখে ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে উল্লেখযোগ্য ঘটনা একটাই। হুড়মুড়িয়ে আমাদের সামনে দিয়ে নদী পার হল গোটা ছয়েক বুনো শুয়োরের পাল। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটল। বন্যপ্রাণ দর্শন তো হল।
একটা সময় ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল ভুটানের অংশ। পাহাড় এবং জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলের যেখান সেখান দিয়ে ভারতে প্রবেশ করা যেত না। নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়াগাই ছিল যাওয়া আসার জন্য নির্ধারিত। এই জায়গাগুলিকেই বলা হত দ্বার বা দুয়ার। এই দুয়ার থেকেই ভুটান হিমালয়ের পাদদেশ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার নাম হয়ে ডুয়ার্স। যার বিস্তৃতি জলঢাকা নদী থেকে অসমের মানস বায়োস্ফেয়ার রিজার্ভের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত। অসমে এরকম আটটি এবং পশ্চিমবঙ্গে দশটি দুয়ার আছে। তবে বর্তমানে তিস্তা থেকে জলঢাকা অবধি বিস্তৃত তরাই অঞ্চলকেও বৃহত্তর ডুয়ার্সের মধ্যে ধরা হয়।
দুপুরের ভোজনের পর সেরকমই একটি দুয়ার পার করে ভুটানে প্রবেশ আমাদের। জায়গার নাম সামশে বা সামচি। ভুটানের কুড়িটি জেলা বা জঙ্গখাগ-এর (Dzongkhag) অন্যতম এই সামশে। আমরা সামশে গুম্ফায় প্রবেশ করলাম। গুম্ফায় ঢুকলেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ভরিয়ে দেয় মনকে। ভিতরের চিত্র, থাঙ্কা দেখে একটা হালকা আঁচ পাওয়া যায় ভুটানের ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং জীবনধারণ সম্পর্কে। প্রকৃতিগত ভাবে দার্জিলিং বা সিকিমে দেখা গুম্ফার সঙ্গে ভুটানের গুম্ফাগুলির নির্মাণ শৈলিতে বিস্তর ফারাক। আসলে ভুটানের গুম্ফাগুলি সবই দুর্গের ধাঁচে নির্মিত। কারণ এগুলি থেকেই নিয়ন্ত্রিত হত প্রশাসনিক কাজকর্ম। এখনও হয় বেশির ভাগ জায়গাতেই।
বিকেলে আমাদের ডেরার সামনের অংশে বসলাম আড্ডা দিতে। আকাশ হঠাৎ কোন জাদুবলে পরিষ্কার। ইতি উতি কিছু মেঘের আনাগোনা। তাদের বেশির ভাগের জঠরেই নেই জলের লেশ মাত্র। পশ্চিম আকাশে সূর্য পাহাড়ের মাথা ছুঁইছুঁই করছে। তার রং এখন কমলা। যে কোনও মুহূর্তে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার প্রস্তুতি। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘেরাও তাই রঙের খেলা দেখাতে শুরু করেছে। কমলা থেকে লাল হয়ে বেগুনীর মিশ্রণে একটা মায়া-বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতি জুড়ে। কাছেই একটা ধনেশ (হর্নবিল) ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। বোধহয় সঙ্গিনীর খোঁজে।
যদি আপনি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় নাই হন, হয়তো বা একটু কুঁড়ে প্রকৃতির। তাতেও কিছু এসে যায় না। কারণ আলস্য কাটানোর জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা এই চামুর্চি।