সর্বোচ্চ আদালতের রায়: কালীপুজোয় স্মরণ করি শব্দশহিদদের
২০১১ সালের পর যাঁরা শব্দশহিদ হয়েছেন, তাঁরা কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি
- Total Shares
শব্দবাজিতে দু’ধরনের শহিদ হয়েছেন, তার মধ্যে একদল মানুষের মৃত্যু হয়েছে শব্দবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১১ জন শব্দশহিদ হয়েছেন। ২০১৭ সালে কেউ শব্দশহিদ হননি, এ বছর এখনও কালীপুজো হয়নি।
পরিতাপের বিষয় হল এই সব শহিদই স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। আজ তাঁরা বিস্মৃত যোদ্ধা। এ বছরও সেই একই ভাবে কালীপুজো হবে, তাঁদের জন্য কেউ কিছুই করবেন না। ব্যতিক্রম হল, একমাত্র চন্দননগরে পরিবেশ মেলাতে এই শব্দশহিদদের স্মরণ করা হয়। চন্দননগরে প্রতিবছর শব্দশহিদদের প্রত্যেকের স্মরণে একটি প্যাভিলিয়নও হয়।
কালীপুজোর আলোয় তাঁদের স্মরণ করা আমাদের দায়িত্ব (উপস্থাপনামূলক ছবি/ ইন্ডিয়া টুডে)
১৯৯৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের কয়েকজনকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার। কিন্তু ২০১২ সাল ও তার পরে যে পাঁচজন শব্দশহিদ হয়েছেন তাঁরা কোনও ক্ষতিপূরণই পাননি (২০১২ ২০১৩ ও ২০১৫ সালে ১ জন করে এবং ২০১৬ সালে ২ জন), না সরকার থেকে না দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে।
শব্দশহিদদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল পিন্টু বিশ্বাসের স্ত্রীর। তিনি অসহায় ছিলেন, তাঁর দু’টি বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছিল। চন্দননগরের সবুজের অভিযান ও পরিবেশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে তাঁকে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছিল। তাঁর মেয়ের বিয়ের সময়ে আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সরকার কিছু না করায় আমরা নিজেরাই তাঁকে সাহায্য করি।
এই হল পশ্চিমবঙ্গে শব্দশহিদদের চেহারা।
এর পরে আরেকটি প্রসঙ্গেরও অবতারণা করতে হয়। বারেবারেই বলা হচ্ছে যে বেআইনি বাজি তৈরির কারখানার কথা। এই সব বেআইনি বাজি তৈরির কারখানায় গরিব মানুষজনই কাজ করেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং দুর্ঘটনার ফলে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭৭ জন। দারিদ্র্যের কারণেই এঁরা বাজির কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন। এঁরা কোনও দিনই কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি।
এঁরা বেআইনি বাজি কারখানায় কাজ করতেন বলেই এঁদের হয়ে কেউ বলেননি। অথচ বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করার দায়িত্ব হল সরকারের। সরকার সেই কাজ করতে পারেনি। এঁদের মৃত্যু হয়েছে।
লাইসেন্সবিহীন কারখানা বন্ধ করা নিয়ে আমি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে (পূর্বাঞ্চল) একটি মামলা করি। ২০১৫ সালে সেই মামলায় পরিষ্কার ভাবে রাজ্য সরকারকে বলে দেওয়া হয় যে রাজ্যের সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করতে হবে। ওই পিটিশনের মধ্যেই আমি বলে দিই যে, যে সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানা চলছে তাদের জরিমানা করা হোক। যাঁরা কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন, সেই জরিমানার টাকা থেকেই তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।
বেআইনি কারখানায় কাজ করেন গরিব মানুষজনই (উপস্থাপনামূলক ছবি/ ইন্ডিয়া টুডে)
অতীতে হাওড়ার বাগনানের একটি বাজি কারখানাতে একজনের মৃত্যু হয়েছিল, কলকাতা হাইকোর্ট তাঁদের এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সেই রায়ের প্রেক্ষিতেই আমার এই আবেদন। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন। এখন বেঞ্চ বসছে না বলেই এ নিয়ে কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না।
বাস্তব হল, ২০০৯ সাল ও তার পরে যে ৬৩ জন মারা গেছেন তাঁরা কেউ কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। এঁদের কেউ প্রান্তিক মানুষ, কেউ শিশু।
রাজ্য সরকার হোক বা কেন্দ্রীয় সরকার, কেউ যদি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান তা হলে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়। অন্য কোনও ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারও মৃত্যু হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে সরকারি ভাবে তাঁদের সরকারি ভাবে সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এই ধরনের প্রতিবাদ করে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁর সেই প্রতিবাদের বিশেষ কোনও মর্যাদা পেলেন না।
সুপ্রিমকোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ অন্তত দেখিয়ে দিল, এই যে ১১ জন প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁদের প্রতিবাদ ছিল সঠিক। তাঁদের প্রতিবাদের ফলে, সেই সব শব্দশহিদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আজ পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিয়ে বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। ভারতের কোনও রাজ্যে এই বিষয়ে প্রতিবাদ করে কোনও মানুষের মৃত্যু হয়নি।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সেই সব শব্দশহিদদের আত্মত্যাগ সফল হল (উপস্থাপনামূলক ছবি/ ইন্ডিয়া টুডে)
কালীপুজো আসছে। সব জায়গায় আলোর রোশনাই। এই অবস্থায় আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা থেকে যায় সেই সব শব্দশহিদদের স্মরণ করা। পরিবেশকর্মী হিসাবে বলেত চাই, এঁদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা।