সন্তানের সঙ্গে এমন ভাবে মিশুন যাতে তারা লাঞ্ছনার শিকার হলে বলতে পারে
সমাজের জীবন দর্শন - পুরুষ হিসেবে মহিলাদের সাথে যেরকম খুশি আচরণ তাদের অধিকার
- Total Shares
তার মনে হলো বুঝি তার গোটা শরীরটাই শক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটি যেন আর নড়তে পারছে না। তার পা দুটি তখন পাথরের চেয়েও ভারী। এক জোড়া মোটা দুটি হাত মেয়েটিকে জোর করে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করে চলেছে। মেয়েটির প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেছে। "ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো তোমার কাকা। তোমার সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকি। তুমি তো আমাকে রোজ দেখতে পাও।" বিড়বিড় করে কথাগুলো বলেই লোকটি মেয়েটির গায়ে হাত বোলাতে শুরু করে দিলে - মেয়েটির ছোট্ট ঘাড় থেকে একেবারে কোমর অবধি। এই কাজ লোকটি আগেও করেছে। বরাত জোরে সেই সময় বাইরে থেকে একটি আওয়াজ শোনা গেল। লোকটি তড়িঘড়ি মেয়েটিকে ঠেলে সরিয়ে দিল আর মেয়েটি টেবিলের মাথায় ধাক্কা খেল। এর পর আর কোনও কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মেয়েটির বয়েস মাত্র ৯।
আর কিছুক্ষনের মধ্যে মেহেন্দি অনুষ্ঠানের জন্যে ছুটতে হবে। তার আগে একটি লেহেঙ্গা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্য্য দেখে নিচ্ছিল তরুণীটি। সেই ঘরে ঠিক সেই সময় এক বয়স্ক লোকের প্রবেশ। সম্পর্কে তিনি মেয়েটির পিসেমশাই বা মেসোমশাই হবেন। লোকটিকে দেখেই তরুণী বলল, " আমাকে কেমন দেখতে লাগছে?" লোকটি কোনও জবাব না দিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল। কয়েক মুহূর্ত তরুণীটিও বুঝতে পারিনি ঠিক কী হল। এরপর ধাতস্থ হয়েই এক ধাক্কায় লোকটিকে সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়ল সেই তরুণী।
তরুণীর বয়স বছর ২০।
"আমি জানি যে তোমার মা ও ভাই-বোনদের দেখভাল তোমাকেই করতে হয়। কিন্তু তার জন্য তোমার মত পরমাসুন্দরী এক মহিলা কাজ করবে কেন? তুমি শুধু আমাকে সঙ্গ দাও, আমি তোমার সব চাহিদা পূরণ করব - গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, হীরে-জহরত সমস্ত কিছুই।" এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই ব্যবসায়ী লোলুপ দৃষ্টিতে লাল টপ ও নীল জিন্স পরিহিত মেয়েটির দিকে তাকালেন। সোফায় বসে ঠান্ডা পানীয় পান করতে করতে মেয়েটি ভাবতে লাগল কী ভাবে ব্যবসায়ীকে না চটিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করা যায়।
মেয়েটির বয়েস ২৫।
এর আগে যতবারই তিনি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন তিনি তার চার বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার ডাক্তার চেম্বারে তিনি একা। সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়া জায়গাটি পরীক্ষা করতে করতে চিকিৎসক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন , "আপনি কি আপনার ঠোঁটে কিছু করেছেন?" ভদ্রমহিলা কতকটা ঘাবড়ে গিয়ে মাথা দোলালেন। "ভারী সুন্দর আপনার ঠোঁটখানি। আমি কি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি।" কয়েক মুহূর্ত পরে বেশ বিব্রত হয়ে ওই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন গৃহবধূ। তারপর থেকে তিনি আর কখনও সেই চেম্বারমুখো হননি।
ভদ্রমহিলার বয়স ৩২।
লোকটি তাকে একটা থাপ্পড় কষিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। মহিলার তখন দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই লোকটির সঙ্গেই তিনি একসময় প্রেম করতেন। আজ সেই লোকটিই তাঁর অফিসঘরে প্রবেশ করে তাঁর উপর হামলা করছে। প্রাক্তন প্রেমিক তাঁর মুখ চেপে ধরে তার ওপর যৌন অত্যাচার করল। এই মহিলা তার সাহসের জন্য গর্ববোধ করতেন আর আজ তিনি তাঁর নিজের অফিসে একজন পুরুষের কাছে কুঁকড়ে গেলেন। অসম্ভব গায়ে ব্যথা, সঙ্গে রক্তপাত। মহিলার আর কোনও কিছুতেই হুঁশ নেই।
মহিলার বয়স ৪৪।
বেশ কয়েকটি আপাত গুরুত্বহীন ঘটনা। মহিলাদের সঙ্গে অশালীন যেন আচরণ খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। একজন মহিলার শরীর স্পর্শ করা বা একজন শিশুকন্যাকে জড়িয়ে ধরাকেও এই সমাজে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয় না। অনেকেই আবার মহিলাদের বুদ্ধি বা প্রতিভা থেকে মহিলাদের শারীরিক সৌন্দর্য্যের প্রতি বেশি আগ্রহী। চাকরিপ্রার্থী মহিলাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অশালীন আচরণ তো হামেশাই ঘটে। আসলে ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ এই সমাজে বহু যুগ ধরেই হয়ে আসছে, এখনও এই ধারা বিদ্যমান।
বিশ্বজুড়ে এখন মহিলারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। যাঁরা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন তারা প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু শিকারিরাও তো কম বড় কেউকেটা নন। এদের কেউ হলিউডের শাহেনশা, কেউ আবার প্রবাদপ্রতিম ক্রীড়া চিকিৎসক, কেউ আবার কোটিপতি চিত্রনির্মাতা, আবার কেউ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রেসিডেন্ট। এরকম নয় যে তারা নিজেদের জগতে ব্যর্থ বা তাঁরা খুব অন্ধকার জগৎ থেকে উঠে এসেছেন বা তাঁদের ভাগ্যে কোনওদিনও সুন্দরী বান্ধবী জোটেনি। তা সত্বেও তাঁরা যৌন লালসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, মহিলা দেখলেই অশালীন আচরণ করে ফেলেন। কারণ তাদের জীবন দর্শন - পুরুষ হিসাবে মহিলাদের সঙ্গে যেমন খুশি আচরণ তাঁদের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদের আমি কুর্নিশ জানাই। বেশিরভাগ মহিলাই তাঁদের জীবনের করুণ অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ্যে বলতে চান না। কিন্তু অনেকেই আবার প্রতিবাদ স্বরূপ এই ঘটনাগুলোর পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দেন। "মি টু" বা "টাইমস আপ"-এর মতো আন্দোলনগুলো মহিলাদের মুখ খোলবার জন্যে সাহস জুগিয়েছে। নিরবতাই এই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে মহিলাদের দুর্বলতা। আর, এই দুর্বলতারই সুযোগ নেওয়া হয়।
তবে প্রতিবাদ কিন্তু অতি সহজ কাজ নয়। সমাজে এখনও পুরুষদের আধিপত্য। আর তাই ভালো ব্যবহার করবার দায়িত্ব এখনও মহিলাদের ওপর বর্তায়। এই পরিস্থিতিতে একজন মহিলাকে এত জোরে প্রতিবাদ করতে হবে যাতে সেই প্রতিবাদ সকলের কানে পৌঁছায়। ওই ছোট্ট মেয়েটাকে সাহস জোগাতে হবে সে যেন তার পিসেমশাই বা মেসোমশাইকে দূরে সরিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে তার মা-বাবাকে তার উপর ঘটে নিগ্রহের কথা বলতে পারে।
বাবা-মাকেও বুঝতে হবে যে তাদের সম্মান কিন্তু শুধুমাত্র সন্তানের শরীরের উপর নির্ভর করে না। তাঁদের সন্তানদের মন, চেতনা ও মানসিকতারও সুরক্ষার প্রয়োজন। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যদি কোনও পুরুষ জড়িয়ে ধরে তা হলে সে নীরব হয়ে যেতে বাধ্য। শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের শিকার হয়ে কেউ যদি নীরব হয়েও থাকে তা হলে সে শুধু একজনের কাছেই মুখ খুলতে পারে – বাবা-মায়ের কাছে।
সন্তানদের ভালবাসুন। তাদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদেরও কথা বলতে সেখান। তাদেরকেও বিশ্বাস করতে সেখান। সন্তানদের নীরবতার কারণ বুঝতে শিখুন। সন্তানদের ভয় উপলব্ধি করতে শিখুন।
সন্তানদের সময় দিন। তাদের কথা মন দিয়ে শুনুন। এবং, এর পর সঠিক পদক্ষেপ করুন। একমাত্র এই ভাবেই এই ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করা যাবে। ওই নয় বছরের মেয়েটি যদি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারে তা হলে সারা জীবন ধরে সে আর নিজেকে নিগ্রহের শিকার হিসেবে ভাববে না। ওই দিন থেকে সে আর নিজেকে একা বলে মনে করবে না।