শিলান্যাসের পরে প্রায় দশ বছরেও রূপায়িত হল না সিকিম-রংপো রেলপথ
এই প্রকল্পে ২৪টি গ্রাম এবং অরণ্যের উপর নির্ভরশীল ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে
- Total Shares
জনসভায় আদিবাসীদের জন্য বুক চাপড়াব, কুমিরের কান্নাও কাঁদব অথচ তাঁদের আইনি ও সাংবিধানিক অধিকারকে মান্যতা দেব না। উন্নয়নের নামে তাদের বনগ্রাম, জল-জঙ্গল-জীবিকা লোপাট হয়ে যাবে। প্রতিবাদ করা যাবে না। করলে ঠিক কী কী দাওয়াই দেওয়া হবে আমরা তা জানি। এও জানি যে, আদিবাসীদের প্রতিবাদ রাস্তায় উপচে না পড়লে আমাদের হুঁশ ফেরে না। আইন-শৃঙ্খলা গেল গেল রব তুলে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ-প্রশাসন। আমরা সচকিত হই।
বনাধিকার আইন, ২০০৬ আদিবাসী, বনবাসী ও পরম্পরাগত ভাবে বনের উপর নির্ভরশীল মানুষের অরণ্যের অধিকার অন্তত খাতায়-কলমে ফিরিয়ে দিয়েছে। আইনে তো বড়মুখ করে বলা হয়েছে, এতকাল বনবাসী মানুষের উপর 'ঐতিহাসিক অন্যায়' সংঘঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? তার সাম্প্রতিক তম ঘটনা ঘটে চলেছে উত্তরবঙ্গে। ঘটে চলেছে সিকিম রেল প্রকল্পের সেবক-রংপো রেলপথ ঘিরে। যার প্রায় পুরোটাই দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার অভয়ারণ্য ও অন্যান্য বনভূমির উপর দিয়ে যাবে। উৎখাত হবে বন ও বনবাসীরা। বনাধিকার আইন বলছে বনবাসীদের গ্রামসভা 'নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ' (এনওসি) অর্থাৎ, কাজ শুরুর ছাড়পত্র না দিলে প্রকল্প শুরু হতে পারবে না। এই ছাড়পত্র পাওয়া গেলে তবেই মিলবে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ এবং কেন্দ্রীয় আদিবাসী মন্ত্রকের অনুমতি। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলছে এই টানাপড়েন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই ওয়াকিবহাল অথচ বনবাসীদের গ্রামসভা গড়ে তোলাটাই মান্যতা পেল না। নিয়ামগিরি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রাম পর্যায়েই স্থির হবে বনভূমির চরিত্র পরিবর্তিত হবে কি না। ডোঙ্গরিয়া কোন্দদের ১২টি গ্রামসভা একযোগে স্থির করে -- না হবে না। নিয়ামগিরি তাদের দেবতা। এই পাহাড়ের সঙ্গে তাদের শুধুমাত্র জল-জমি-জীবিকার সম্পর্ক নয়, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে বক্সাইট খনি হতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত ৪৪.৯৮ কিলোমিটার রেলপথ হওয়ার কথা
২০০৯ সালে সিকিম রেলপথের আনুষ্ঠানিক শিলান্যাস করেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত ৪৪.৯৮ কিলোমিটার রেলপথ হবে। এর মধ্যে ৪১.৫৪ কিলোমিটার পড়ছে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় এবং ৩.৪৪ কিলোমিটার সিকিমে। সেই সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১,৩৩৯.৪৮ কোটি টাকা। কথা ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। বর্তমান ব্যয়ভার দাঁড়িয়েছে ৪,১০০ কোটি টাকা।
সিকিমের সঙ্গে দেশের অন্যান্য প্রদেশের যোগাযোগের একমাত্র পথ ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। ব্রডগেজ রেলপথ যেমন যোগাযোগ বাড়াবে তেমনই সামরিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সমস্যা হল গত প্রায় ন'বছরে পরিবেশ ও বনবাসী সংক্রান্ত বিষয়গুলির সুষ্ঠু মীমাংসায় সরকার আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসেনি। রেলপথের জন্য মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ৮৬.৬১ হেক্টার এবং অন্যান্য বনভূমি প্রয়োজন বলে রেল জানায়। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট মহানন্দার ৮.৮৪ হেক্টর বনভূমির চরিত্র বদল করা যাবে বলে রায় দেয়। কিন্তু গ্রামসভা অনুমতি না দিলে তা কার্যকর করা সম্ভব নয়।
দার্জিলিং-কালিম্পঙের এই অঞ্চল গোর্খা টেরিটোরিয়াল অথরিটি'র (জিটিএ) অধীন। বিমল গুরুঙের আমলে জিটিএ দাবি তোলে রেলপথ করতে হলে (১) তাদের অধীন ১৬৫টি বনগ্রামের পাঁচ হাজার গ্রামবাসীকে বনাধিকার আইন অনুযায়ী পাট্টা দিতে হবে। (২) টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং এলাকা উন্নয়নের কাজে তাদের যুক্ত করতে হবে। (৩) স্থানীয়দের স্থায়ী চাকরি দিতে হবে। প্রসঙ্গত, বনাধিকার আইন চালু হওয়ার পর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কিছুটা জঙ্গলমহলের সামান্য কিছু মানুষ জমির নামমাত্র পাট্টা পেয়েছেন। দার্জিলিং-কালিম্পঙে কেউ পায়নি। একটি কারণ অবশ্য পাহাড়ি অঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা না থাকা। রাজনীতিকদের মতে, জমির পাট্টা কিংবা চাকরির দাবি আসলে এ করকম ভাবে জনমত তৈরি করা। গুরুঙের মূল উদ্দেশ্য ছিল টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ে ঠিকাদারির কাজ হাসিল করা।
রেলপথের জন্য মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ৮৬.৬১ হেক্টার এবং অন্যান্য বনভূমি প্রয়োজন
পাহাড়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিকিম-পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্তরও এখন বন্ধু ভাবাপন্ন। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবনকুমার চামলিং সমর্থন করায় দুই রাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। গত ১৬ মার্চ দু'রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে ফের রেলপথের কাজ দ্রুত শেষ করার কথা ওঠে। সে বিষয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেন মমতা।
যদিও বিগত আড়াই বছর ধরে নানা ভাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নরমে-গরমে ছাড়পত্র দেওয়ার চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন হিমালয়ান ফরেস্ট ভিলেজার্স অর্গানাইজেশন -এর সাধারণ সম্পাদক লীলা গুরুং এবং পরিবেশ ও বনাধিকার বিষয়ক সংগঠন নেসপন-এর সম্পাদক সৌমিত্র ঘোষ। তাদের সাফ বক্তব্য, 'গ্রামসভার ছাড়পত্রের কথা পরে হবে। আগে পাহাড়ের ১৬৫টি বনগ্রামকে রাজস্ব গ্রাম ঘোষণা করুক সরকার। বনবাসীদের জমির অধিকার দিক।' তাদের মতে রেল প্রকল্পের জন্য ২৪টি গ্রাম এবং বনের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবে।
সরকার অবশ্য বসে নেই। গত এপ্রিলে তিস্তা এলাকার ১৭টি গ্রামকে একের পর এক নোটিশ ধরায় সংশ্লিষ্ট বিডিও অফিস। নোটিশের মর্মবস্তু হল, সেবক-রংপো রেললাইন নির্মাণের জন্য বনাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার 'এনওসি', অর্থাৎ ছাড়পত্র দেওয়া হোক। এই মর্মে গ্রামে সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। বনাধিকার আইন অনুযায়ী বিডিও কেন, নব্বান্নও এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু প্রশাসনের এই ভূমিকার পিছনে রয়েছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের, ০৩.০৩.২০১৭ তারিখের একটি সরকারি নির্দেশ। সেখানে বিডিও'দের এনওসি বা ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য গ্রামসভা ডাকার ক্ষমতা দেয়। আন্দোলনরত দুটি সংগঠনই সেই সভার ডাক প্রত্যাখ্যান করে। এমন আইনি অধিকার পঞ্চায়েত দপ্তর বা বিডিও'র নেই।
আপাতত সরকার কিছুটা ধীরে চলার নীতি নিলেও সরকারি আধিকারিকরা গ্রামে গ্রামে প্রকল্পের জমির মাপজোকের জন্য আমিন পাঠাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বিরোধিতার জলও মাপছে তারা। তথ্য জানার অধিকার আইনে ঠিক কত জমি প্রকল্পের জন্য নেওয়া হবে, মোট কত গ্রাম, কত বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন বেশ কিছু তথ্য জানতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলি।