৩৭৭ ধারার অস্তিত্ব এখনও রয়েছে, বিষয়টি সত্যিই লজ্জাজনক
সমকামিতা অস্বাভিক নয়, কোনও ইচ্ছাকৃত আচরণ নয়, কোনও বিকৃত আচরণও নয়
- Total Shares
মঙ্গলবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা খোঁজা শুরু করেছে। এই ধারায় সমকামিতা-সহ যে কোনও ধরণের 'অস্বাভাবিক যৌন মিলন'কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই শুনানির ফলপ্রকাশ নিয়ে সকলেই যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই বিষয়ে আদালতের অবস্থান ঠিক করে দেবে যে আমাদের সমাজ আদৌ ঠিক কতটা অগ্রসর হয়েছে। কোনও পরিণত গণতন্ত্র বা কোনও সমাজ যা প্রতিটি মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী কখনোই এমন আইন প্রণয়ন করতে পারে না যে আইনে যৌন প্রবৃত্তির উপর মানুষকে আলাদা করে দেখা হয়।
এর চেয়ে গুরত্বপূর্ণ, আদালতের পর্যবেক্ষণ কিন্তু লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র জীবন মর্যাদা রক্ষা করতে পারে। তাঁদের এমন একটা জীবন দিতে পারে যে জীবনে এমন কোনও আইন থাকবে না যার দ্বারা তারা অপমানিত হতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনও রকম 'নীতি পুলিশের' সম্ভাবনা থাকবে না। তারা কোনও ধরণের বৈষম্যতারও শিকার হবে না।
[ছবি: পিটিআই]
বিতর্কের কোনও জায়গা নেই
সমকামিতা অস্বাভাবিক নয়, ভারতীয় সাইক্রিয়াটিক সোসাইটি ও এই দাবি করেছে। এটি কোনও ধরণের জীবনচর্যার সমস্যা নয়। এটি কোনও ধরণের বিকৃত মনোভাব নয়। আর পাঁচ জন মানুষ যে রকম ডান হাতি বা বাঁ হাতি হন, কিংবা খর্বকায় বা লম্বা হন এগুলো যেমন স্বাভাবিক, কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেন না, এ ক্ষেত্রেও তাই। কেউ নিজে এই আচরণের জন্য দায়ী নন।
কাউকে যদি তার জন্মগত আচরণ লিয়ে লজ্জিত হতে হয় তা হলে তাহলে তা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। সামাজিক কুসংস্কার বা সমাজ চায় না এমন কোনও বিষয় নিয়ে যদি কেউ অবহেলিত হয় সেটিও কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। আর, এ জন্য দেশের এলজিবিটি সম্প্রদায়কে চড়া মূল্য দিতে হয়, তাঁদের প্রতিদিনই যুদ্ধ করতে হয়।
কেউ যে আলাদা তা সহজে অনুধাবন করা যায় না। তাই তো সমকামী টিনেজারদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে বেশ কয়েকজন চিত্রতারকা বা সেলিব্রিটি এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা নিজেদের সমস্যার কথা খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন না, তাঁরা নিজেদের কাউন্সেলিং করাতেও সাহস পান না।
একই দুরবস্থা বাবা-মা, অবিভাবকদের। তাঁরাও তাঁদের সন্তানদের দুঃখ বুঝতে পারেন না। তাঁরাও আঁচ করতে পারেন যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা অবহেলা লাঞ্ছনার শিকার হবে। আর, তাই তাঁরাও ভেঙে পড়েন। তাঁদের জীবনও কঠিন হয়ে ওঠে।সমকামিতা যদি আইনি স্বীকৃতি পায় তাহলে এই নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হবে। তাহলে সমকামিতা নিয়ে মানুষের মনে জমে থাকা ভ্রান্ত ধারণাগুলো পরিষ্কার হবে। সমকামীদের জন্য এটা প্রয়োজনীয়। এটা সমাজের জন্যেও প্রয়োজনীয়।
অকারণ হেনস্থার শিকার
সমকামিতা বেআইনি হলে অন্য ধরণের অপরাধ দেখা দিতে পারে। দ্য সানডে গার্ডিয়ানের আরটিআইয়ের উত্তরে জানা গেছে যে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দিল্লি পুলিশ সমকামিতার অভিযোগে মোটামুটি শ'খানেক লোককে আটক করেছিল। কিন্তু এদের আর্ধেকের বিরুদ্ধেও ৩৭৭ ধারায় মামলা রুজু করতে পারেনি কারণ সেই অভিযোগগুলো মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
যে সব সমকামীরা অত্যাচারিত, অবহেলিত বা শারীরিক বা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে তারা আইনের দরজায় কড়া নাড়তে পারে না কারণ আইন তাদের বৈধতা দেয় না।
যে আইন মানুষকে সুবিচার দিতে পারে না সেই আইন না থাকাটাই শ্রেয়।
[ছবি: পিটিআই]
বৈধতা ও নৈতিকতা
আইনত ৩৭৭ ধারা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে। ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়তে বলা হয়েছে: “Privacy includes at its core the preservation of personal intimacies, the sanctity of family life, marriage, procreation, the home and sexual orientation... Privacy also connotes a right to be left alone.”
এতে পরিষ্কার ভাবে সমকামিতাকে বৈধ করা হয়েছে। এর পর যদি সুপ্রিম কোর্ট অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে তাহলে নিজেদের রায়কেই অস্বীকার করা হবে।
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট যে ৩৭৭ ধারাকে পুনর্বহাল করল তখনও আদালতের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে সংসদ আইন প্রণয়ন করবে, আদালত নয়। কিন্তু এই আইন কোনও দিনও সংসদে পেশ করা হয়নি। আইনটা ব্রিটিশদের তৈরি ছিল। অথচ ব্রিটিশরাই সমকামিতার আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৬৭ সালে।
অনেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিচ্ছেন। কিন্তু প্রাচীন ভারতেও আমরা সমকামিতার উদাহরণ পাই।
একটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল করতে দশক কখনও কয়েক শতাব্দীও অতিক্রম করে যায়। কিন্তু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন। তা যদি না হত তাহলে সতীদাহ প্রথা আজও আইনসিদ্ধ রয়ে যেত।
সমস্যাটা হচ্ছে যে ২১ শতকেও আইন দুই প্রাপ্তবয়স্কর বেডরুমে ঢুকে তাদের নীতিবাক্য পাঠ করাচ্ছে।
একটি আইন যা শুধুই মানুষকে বিহ্বল করে সভ্য সমাজে তার কোনও জায়গা নেই।