সোমালিয়ার জলদস্যুদের থেকে বেঁচে ফিরেছি, নিষ্কৃতি পেয়েছি অ্যামাজানের কুমিরের মুখ থেকেও
-৬৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও জাহাজে আমরা, তখন -৫ ডিগ্রিকেও স্বাভাবিক বলে মনে হত
- Total Shares
তখন আমার বছর কুড়ি বয়স। সেই বয়সের আর পাঁচটি তরুনের মতো তখন আমার দু'চোখ জুড়ে শুধুই একটি 'অন্যরকম' কেরিয়ারের স্বপ্ন। আর সেই 'অন্যরকম' কেরিয়ারের স্বপ্ন তাড়া করতে গিয়ে নাউটিক্যাল বিজ্ঞানের স্নাতক হবে বলে ঠিক করলাম। সিন্দাবাদ কিংবা ট্রেজার আইল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের মতো এবার আমারও নাবিক হয়ে ওঠার পালা। জাহাজে চড়ে আমার মতো করে বিশ্ব ভ্রমণ।
কিন্তু স্নাতক হয়ে ওঠার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমাকে। মেরিন জগতে সেই সময়ের মন্দার বাজার, তাই চাকরি পেলেও কাজ পাচ্ছিলাম না। মানে জাহাজে ওঠা আর হয়ে উঠছিল না। অবশেষে ২০০৪ সালের শুরুতে অ্যাপিজে শিপিং আমাকে সেই 'স্বপ্নের' সুযোগটা দিল। ইংল্যান্ডের মোহনায় অবস্থিত ব্রিস্টল পোর্টে। আর বাঙালি নাবিকের বিশ্ব ভ্রমণ সেই শুরু। পৃথিবীর যেখানেই মেরিন পরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেই ছুটতে হয়েছে আমাকে। তা সে জায়গা যতই দুর্গন হোক না কেন।
আমার নাবিক জীবনে বিভিন্ন অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমি। এর মধ্যে সিংভাগই ভয়াবহ। আতঙ্কের। ইন্দোনেশিয়ার মালাকে প্রণালীতে এবং সোমালিয়াতে জলদস্যুদের সামনে পড়েছিলাম। আবার একবার অ্যামাজোনে জলে পড়ে একেবারে কুমিরের সামনে আমি। সৌভাগ্য, সেই জল থেকে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলাম।
কাজের সূত্রে, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন মহাসমুদ্র আবার কখনও সরু নদী এমনকি খালের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চালাতে হয়েছে আমাকে। তবে এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে শক্ত কাজটা পেয়েছিলাম ২০১০ সালে যখন হংকংয়ের একটি কোম্পানিতে আমি চাকরি পাই। সেই কোম্পানি আমাকে আইস ক্লাস ভেসেল্সে কাজ দেয়। এই জাহাজে মূলত কানাডার উত্তরের ও রাশিয়ার হিমশীতল জলে কাজ করে।
কঠিন ছিল সেই বরফের দিনগুলো [সৌজন্যে: লেখক]
দিনগুলি সত্যিই কঠিন ছিল। সেই জাহাজে আমরা দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে কানাডা, আর্কটিক, আইসল্যান্ড ও রাশিয়ার মতো শীতপ্রবণ দেশগুলোতে পৌছিয়ে দিতাম। বললে হয়ত বিশ্বাস করবেন না, সেই সময় আমাদের বেশ কিছুদিন -৬৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও কাটাতে হয়েছিল। এর ফলে একটা অদ্ভুত অনভূতি তৈরী হয়েছিল আমার মধ্যে। গ্রীষ্মকালীন দেশের ছেলে হয়েও একটা সময় -৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। মানে কোলকাতায় শীতকালে যে পোশাক পড়ি সেই পোশাকেই -৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারতাম আমি।
নাবিক হওয়া কিন্তু মুখের কথা নয়। বাইরের তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন আপনাকে কাজ করে যেতেই হবে। জাহাজ মাঝসমুদ্রে থাকলে তো দিনরাত কাজ করতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে শরীরের ফিটনেস কিন্তু মারাত্মক হতে হবে। আর এর জন্য আপনাকে কাজটা ভালোবাসতে হবে। শুধু মাত্র অর্থ রোজগার করে এই পেশায় কাজ করা যায়না। অর্থ দিয়ে সবসময় নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, এই পেশায় আপনার যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় তা অন্য খুব একটা বেশি পেশায় হবে না। সুতারং, আমি ভাগ্যবান।
আমার নাবিক জীবনের আমি বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে কাজ করেছি। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে কাজ করাটাও আমার জীবনের একটি মূল্যবান শিক্ষা। দেখেছি কাজের সময় আমার সহকর্মীরা কী ভাবে দিনরাত এক করে কাজ করে। কাজ ছাড়া আর কিছুই জানে না। আবার তাঁরাই কাজ শেষে হলে তাঁরাই কী ভাবে পার্টিতে উল্লাসে ফেটে পড়ে। মার্চেন্ট নেভির পার্টি এক অন্যান্য অভিজ্ঞতা। সুস্বাদু খাবার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের দুষ্কর পানীয় একি সহজে ভোলা সম্ভব। তা ভুলে গেলেও, এই পার্টিগুলোতে সুন্দরী রমনীদের নাচ যে আপনার চিরজীবন মনে থাকবে তা আমি হলফ করে বলতে পারি।
ডেকে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনতাম কখন দেশে ফিরব [সৌজন্যে: লেখক]
১২ বছর ধরে মার্চেন্ট নেভিতে চাকরি করেছি আমি। এর পর পরিবারের সঙ্গে জীবন কাটাতে আর জীবনটা একটু 'অন্যভাবে' উপভোগ করতে নতুন পেশায় যোগ দিয়েছি আমি।
নাবিক থাকার সময়ে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনতাম কখন পাড়ে একফালি জমির খোঁজে। ভাবতাম ওই জমিটার নাম ভারত। আর এই ভারতেই কলকাতা বলে একটি শহর আছে। যে শহর আমার বাড়ি। যে শহরে আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাস। আর, এখন, পরিবার নিয়ে সমুদ্রে বেড়াতে গিলে দূরসমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে জাহাজগুলোর থেকে চেয়ে থাকি। ভাবি আমার মতো কোনও এক নাবিক হয়ত ডেকে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার প্রহর গুনছে।
এই না হলে জীবন। নাবিকের জীবনের মতোই যা প্রবাহমান। সূর্য উঠবে, সূর্য অস্ত যাবে - জাহাজের মতো আমাদের জীবনও চলতে থাকবে। শুধু চারিপাশের ভূগোলটা বদলে যাবে।