রাশিয়ান সার্কাস, রাশিয়ান মহিলা আর রাশিয়ান 'বাংলা' মানে ভদকা আমাকে আকৃষ্ট করেছে বারেবারে
রুশ অভিনেত্র্রী রাবিন কিনা 'মেরে নাম জোকার'-এ অভিনয় করেছিলেন, তাঁকে দেখে আমি যথারীতি অভিভূত
- Total Shares
গোর্কি সদনের রাশিয়ার এম্বাসির অফিস কাউন্টারে হ্যানা বলে সুশ্রী এক যুবতী যখন পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিল তখন আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। 'ওয়েল মি. গোস্বামী আর দুটো ওয়ার্কিং দিনের মধ্যেই দিল্লী থেকে ফাইনাল ছাড়পত্র চলে আসবে। ডোন্ট ওয়ারি!' প্রত্যুত্তরে ওকে বাই বলে বাইরে বেরোলাম। কলকাতার আকাশ থেকে টেকঅফ করলাম এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পর, ৬ জুলাই ২০১৬। এমিরেটসের দুর্দান্ত উড়ান প্রথমে আমায় নিয়ে এল দুবাই। ওখানে ঘণ্টা পাঁচেকের বিরতি। দুবাইয়ের সময় ঠিক বিকেল ৫.৩০ মিনিটে আরও বড় একটা ফ্লাইটে পাড়ি দিলাম মস্কো।
ছোটবেলা থেকে মস্কোর প্রতি আমার একটা অদম্য টান। রুশদেশের উপকথা কচি বয়স থেকে পড়েছি - রাজপুত্র ইভান, কুঁড়ের বাদশা ইয়েমেল্লা, রাজকুমারী জাদুকরী ভাসিলিসা আর ডাইনি বুড়ি বাবা ইয়াগার রোমাঞ্চকর গল্পগুলো গোগ্রাসে গিলেছি। বরফের মধ্যে দিয়ে রেললাইন চলে গেছে অথবা বিশাল ফারের জঙ্গলে রাজকুমারের ঘোড়ায় রাজকুমারী চলছে - আলো আঁধারিতে উড়ে যাচ্ছে সোনালী চুল, লাগছে ইভানের চোখে মুখে - এসব নিজের মনে মনেই বানিয়ে গেছি। সিনেমার মতো তারাও কখন ঢুকে পড়েছে আমার স্বপ্নের একান্ত স্ক্রিনে। গল্পে বিশাল মুরগীর ঠ্যাং দিয়ে তৈরি হয়েছে বাবা ওয়াগার কুঁড়ে ঘর। সে ঘরটা আবার যখন তখন ঘুরতেও পারে। ডাইনি বুড়ির ঝাঁটার মতো চোখ আর মুলোর মতো দাঁত। বাংলার ঠাকুমা আর রুশি ডাইনি আমার মগজে একাকার হয়ে গেছে।
রাজপুত্র ইভান, আমার কচি বয়েসের স্বপ্নের নায়ক
আর একটু বড় হয়ে পড়েছি ম্যাক্সিম গোর্কির 'মাদার'। নাড়া দিয়েছে সে গল্প আমার কিশোর মনকে। তলস্তয়, পুশকিন, চেকভ, মায়কভস্কি, দত্তভয়েস্কি আরও পরে সোলঝেতসনিন একে একে ছুঁয়ে গেছে আমাকে। নিয়ে গেছে, আমায় এক অদ্ভুত জগতে যার নাম সোভিয়েত - পরে রাশিয়া। রাশিয়ান সার্কাস, রাশিয়ান মহিলা আর রাশিয়ান 'বাংলা' যাকে ভদকা বলে আমাকে আকৃষ্ট করেছে বারেবারে। রাবিন কিনা বলে এক রুশ অভিনেত্র্রী রাজ কাপুরের 'মেরে নাম জোকার'-এ অভিনয় করেছিলেন। তাঁকে দেখে আমি যথারীতি অভিভূত।
পাকেচক্রে মাঝ বয়েসে আমার এক রুশ বান্ধবীও হল। তাঁর মেয়ে থাকে মস্কোতে। মূলত তাঁদেরই উদ্যোগে এবং আহ্বানে আমি পারি জমিয়ে দিলাম জুলাই মাসে। মস্কোর উদ্দেশ্যে। 'খারাসো খারাসো' মানে ভালো ভালো আর 'দাসয়িদানিয়া' মানে আবার দেখা হবে সামান্য এই দুটি রুশি কথা সম্বল করে। সন্ধ্যেবেলা ফ্লাইটে সবাই মজা করে ঘুমোচ্ছে। আই একটা ওয়াইন নিয়ে বসে আছি জানলার পাশে। বাইরে কালো মেঘের পাহাড়। বিদ্যুৎ চমকানির মতো প্লেনের পাখার নিচের দিকে আলোটা ঝলসে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে যেন রহস্যময়ী রাশিয়া যেন দু'হাত বাড়িয়ে আমায় ডাকছে। আমর চোখ টিভি স্ক্রিনে। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ফ্লাইট চলেছে বিশালকার ইউরোপ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে।
রাজ কাপুরের সিনেমার সেই রুশ অভিনেত্রী
আমি যখন দামাদিদোভা এয়ারপোর্টে নামলাম তখন ওদের সময় প্রায় রাত দশটা। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা পিছিয়ে আছে মস্কো, কলকাতার থেকে। আমি ঘড়ির সময় পাল্টায়নি। ইমিগ্রেশনে খুব একটা কড়াকড়ি নজরে পড়ল না। আধঘণ্টা মতো সময় গেল সুটকেসেটা পেতে। আমি তখন ক্লান্তিতে বেঁকেটেরে গেছি। শরীর আর দিচ্ছে না। সকাল ছ'টায় সল্টলেক থেকে বেড়িয়েছি ন'টা চল্লিশের প্লেন ধরব বলে। 'মিস্তর, ফ্রম হুইচ কান্ট্রি ইউ আর কামিং' - আঁটোসাঁটো ড্রেস, সোনালী চুল আর নীল চোখের এক অধিকারিণী আমাকে জিজ্ঞাসা করল। ইন্ডিয়া বলাতে একটু হাসল। পরের প্রশ্ন ট্যাকে কত ডলার নিয়ে এসেছি। হোটেলের ভাউচার আছে কিনা। হাতের ব্যাগ খুলে দেখালাম টাকা পয়সা, হোটেলের স্লিপ। 'ওয়েলকাম তু রাশিয়া' মিষ্টি হেসে হাত দেখাল মেয়েটি গেটের দিকে।