ভিআই লেনিন স্টেডিয়াম এখন লুঝনিকি স্টেডিয়াম, কোনও নামগন্ধ নেই সোভিয়েত প্রতিষ্ঠাতার
রাশিয়া নাকি কোনও নথি নষ্ট করে না অতীতকেও ভোলে না, অথচ ভুলে গেল লেনিনকে
- Total Shares
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর। বরফে ঢেকে গিয়েছে মস্কো শহর। গাছের পাতা, বাড়ির ছাদ, ফুটপাথ সবই বরফে আবৃত। সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে আমি গিয়েছি ১৯৮০ মস্কো অলিম্পিক্সের প্রস্তুতি দেখতে। আমাদের যেমন ময়দান অঞ্চল, মস্কোয় তেমনি বিশাল একটি অঞ্চলের নাম লুঝনিকি। এই অঞ্চলে জনবসতিও রয়েছে। কিন্তু একটি বিশাল ফাঁকা অঞ্চল ঘিরে নানান খেলার কেন্দ্র। খোলা স্টেডিয়াম, ইনডোর স্টেডিয়াম, ওয়াটার পোলো কেন্দ্র প্রভৃতি রয়েছে। অলিম্পিক্সের কর্তারা এই অঞ্চলটি দেখিয়ে বললেন এটি হল লেনিন সেন্ট্রাল স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স। আগামী বছর অলিম্পিক্সের বেশিরভাগ ইভেন্ট হবে এখানেই। মূল স্টেডিয়ামের নাম ভিআই লেনিন স্টেডিয়াম।
৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান (ছবি: রয়টার্স)
পরের বছর ১৯ জুলাই এখানেই হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। শীতের মধ্যে বহু লোক ব্যস্ত রয়েছেন অলিম্পিক্সের প্রস্তুতির কাজে। সকলেরই হয়ত মনে আছে ১৯ জুলাই মিশা বিশ্ববাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছিল শান্তি ও মৈত্রীর ক্রীড়া অলিম্পিক্সে আসার জন্য। তারপর সেখানেই হয়েছিল ট্র্যাক ও ফিল্ডের সব ইভেন্ট, ফুটবল ফাইনাল প্রভৃতি। আর ৩ অগস্ট অলিম্পিক্সের সমাপ্তি দিনে অনির্বাণ মশাল নেভার আগে সেই মিশা চোখের জলে বিদায় দিয়েছিল অলিম্পিক্সে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়দের।
সেদিন ১ লক্ষ ৩ হাজার দর্শক চোখের জল ফেলেছিলেন। মিশা হাত নেড়ে নেড়ে যা বলছিল তা রুশ ভাষায় হল 'দাসভিদানিয়া'। সারা পৃথিবী জেনেছিল ভিআই লেনিন স্টেডিয়ামেই অলিম্পিক্স হয়েছে।
এই স্টেডিয়ামে সোভিয়েতদের বড় বড় ফুটবল প্রতিযোগিতা, অ্যাথলেটদের বড় বড় ইভেন্ট হয়েছে। ২০০৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফুটবল ফাইনালও হয়েছিল ভি আই লেনিন স্টেডিয়ামে।
ভিআই লেনিন স্টেডিয়াম, বর্তমানে লুঝনিকি স্টেডিয়াম নাম পরিচিত (ছবি: এএফপি)
রাশিয়া যখন ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের দায়িত্ব পেল তখন থেকেই ১১টি শহরে নতুন নতুন স্টেডিয়াম ছাড়াও পুরোনোগুলো সংস্কার করা হল। ফিফার নিয়মে কোনও স্টেডিয়ামের দর্শক সংখ্যা ৮০ বা ৮১ হাজারের বেশি হবে না। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ভি আই লেনিন স্টেডিয়ামেও সংস্কারে হাত দেওয়া হয়। সংস্কার শুরু হয় ২০১৩ সালে আর শেষ হয়েছে গত বছর।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপার হল, লেনিন স্টেডিয়ামের বহির্ভাগ একই রকম রয়েছে। স্টেডিয়ামের প্রবেশ মুখে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের বিশাল মূর্তিটিও। কিন্তু স্টেডিয়ামের নামটি বদলে গিয়েছে। সারা বিশ্ব এখন জানছে এটি লুঝনিকি স্টেডিয়াম। মূর্তিটুকু ছাড়া কোথাও লেনিনের নামগন্ধ নেই।
জারের রাশিয়ার পর সমাজতান্ত্রিক সরকার তাদের আর্কাইভসে সবই রেখে দিয়েছে, কিছুই নষ্ট করেনি। রাশিয়ার আর্কাইভস নিয়ে ইতিহাসবিদরা গর্ব করেন। ওঁরা নথিপত্র নষ্ট করেন না। তা যতই তাদের সময়কার রাজনৈতিক বিরোধী হোক না কেন। কিন্তু বর্তমান রুশ সরকার বেমালুম ভুলে গেল তাদের ঐতিহ্যের স্টেডিয়ামটির নাম।
স্টেডিয়ামের প্রবেশ মুখে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের বিশাল মূর্তিটিও (ছবি: রয়টার্স)
বারচারেক সোভিয়েত সফরের অভিজ্ঞতার সময় দেখা হয়েছিল প্রাভদা, ইজভেস্তিয়া প্রভৃতি খবরের কাগজের সাংবাদিকদের সঙ্গে। তাঁরাও গর্ব করে বলতেন, "আমরা রেকর্ড নষ্ট করি না।" অতীতকে ভুলি না। কিন্তু আজ বিশ্বকাপ ফুটবল টিভিতে দেখতে দেখতে শুনছি খেলা হচ্ছে লুঝলিকি স্টেডিয়ামে। নেটে দেখছি পৃথিবীর কোনও খবরের কাগজও লুঝলিকি স্টেডিয়ামের আসল ইতিহাস লিখছে না।
মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়, বিভিন্ন জনের কথা শুনে বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। প্রশ্ন জাগছে রুশিরাও কি তাই? ভুলে গেলেন ভি আই লেনিনকে?