ব্রিটিশ সমর্থকরা 'হুলিগান' কেন, জানতে হলে নাকি ইংল্যান্ডের হারের অপেক্ষা করতে হবে
সেন্ট্রাল লন্ডন, দক্ষিণ কিংবা আরও পশ্চিমের দিকে গেলে বোঝা যাবে ব্রিটিশরা সমর্থক নন বিপ্লবী
- Total Shares
ছোটবেলায় ফুটবলটা ফলো করতাম। প্রশান্ত ব্যানার্জির ফ্রী-কিক, শিশির ঘোষের হেড থেকে গোল, দলবদলের সময় চ্যাংদোলা করে ফুটবলার তুলে নিয়ে যাওয়াটা বেশ মনে আছে। কিন্তু জীবন থেকে ফুটবলটা বিদায় নিয়েছিল স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই।
শুধুমাত্র '৮৬-র মারাদোনার সৌজন্যে ওই চার বছরে একবার বিশ্বকাপ এলে সাময়িক ভাবে এসে যেত অন্য দেশভক্তির অনুপ্রেরণা। আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের জাতীয় সংগীতটাও প্রায় শিখে নিয়েছিলাম একসময়। যেন আগের জন্মে রিও বা বুয়েন্স অয়ার্স-এই জন্মেছিলাম। আজ ৪০ পেরিয়ে ইংল্যান্ডে ব্যবসা করতে এসে সেই দিনগুলোই মনে পড়ছে. কেননা এই দেশে খেলা একটাই, ফুটবল। ক্রিকেটটা যে এই দেশে কে বা কারা খেলে সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
আমি থাকি ইস্ট লন্ডনের বার্কিংয়ে। এখানে প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশি কিংবা দক্ষিণ ভারতীয়দের বাস। বলা বাহুল্য, দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ করে তামিল, তেলেগু আর কানাড়া ভাষাভাষীদের মধ্যে ফুটবলটা সিলেবাসে নেই। তাই বাংলাদেশি (পড়ুন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সমর্থক) আর আমাদের মতো কিছু হাতে গোনা ভারতীয় বাঙালিদের (আবার পড়ুন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সমর্থক) মধ্যে বিশ্বকাপ নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা আছে। এখানে একটু বলে রাখি, ভারতীয় বাঙালিরা বেশিরভাগ একদম উত্তর-পশ্চিমে মানে হ্যারো, স্লাও কিংবা হাউন্সলোর দিকে থাকে। এটাও ঘটনা যে, ইংল্যান্ডের সমর্থক এদের মধ্যে কেউ নয়. ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকলেও। কিন্তু একটু সেন্ট্রাল লন্ডন, দক্ষিণ কিংবা আরও পশ্চিমের দিকে গেলে বোঝা যাবে আসল দৃশ্যটা।
মানে আমাদের ভাষায় যেটা 'গোরা অধ্যুষিত'। ওরে বাবা! এরা তো সমর্থক নয়, একেবারে বিপ্লবী।
ওরে বাবা! এরা তো সমর্থক নয়, একেবারে বিপ্লবী
চলে আসুন যে কোনও টিপিক্যাল ব্রিটিশ পাবে। যদি খেলা চলে তো ভালো, না হলেও কোনো সমস্যা নেই। সবাই মোটামুটি অফিসের সাদা জামা খুলে দেশের জার্সি পরে বিয়ার খাচ্ছে। সঙ্গে চলছে সবার জমজমাট 'বিশেষ টিপ্পনি'। এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দল 'হ্যারিকেন' নিয়ে যতই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠুক না কেন, টিভি কমেন্টেটর থেকে বার-টেন্ডারের দেশভক্তিটা শুধু দেখতে হয়। যেন বিশ্বকাপটাই জিতে গিয়েছে, জাস্ট দু-তিনটে খেলা বাকি।
ভারতীয়, থুড়ি বাঙালি হিসেবে এটা আমার কাছে অনেকটা কেস স্টাডির মতো। এদের কাছে আত্মসমালোচনার কোনও জায়গা নেই। ওরা খুশি কলাম্বিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে বলে। কিভাবে, কী করে, সেটা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। আর সঙ্গে সেলিব্রেশন। কলসি নিয়ে বিয়ার খেতে খেতে এক ব্রিটিশ মধ্যবয়সি বললেন, "মিডিয়া আমাদের খেলোয়াড়দেরকে সমালোচনা করে মনোবল ভেঙে দেয় না। বরঞ্চ বাড়াতে সাহায্য করে।"
সেটা আরও ভালো বুঝতে পারলাম ফার্স্ট রাউন্ডে শেষ খেলাটায় ইংল্যান্ড যখন বেলজিয়ামের কাছে এক গোলে হেরে গেলো। আমাদের দেশ হলে হয়তো কোচ, ফুটবলারদের বাপ-বাপান্ত চলতো। কিন্তু এখানে কেউ কোথাও একবারের জন্য বললো না 'দলটা ভুলভাল'। ব্রিটিশ প্রিন্ট মিডিয়া তাও একটু সমালোচনার পথে হাঁটে। কিন্তু সেটা সিন্ধুতে বিন্দু। হয়তো এটাই ব্রিটিশ কালচার। এটা কলকাতায় বসে ভাবতে পারতাম? সৌরভ গাঙ্গুলির খারাপ ফর্মে সবচেয়ে বেশি শব্দের "বিশেষণ" বাঙালিরাই বোধহয় ব্যবহার করেছিল। গোটা লন্ডন শহরে রেড ক্রসের মতো দেখতে ইংল্যাণ্ডের পতাকা ভর্তি। সবার বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে গাড়ির কাঁচের মধ্যেও উঠিয়ে রাখা হয়েছে পতাকা। পিকাডিলি স্কোয়ারের জায়ান্ট ইলেক্ট্রনিক বিলবোর্ডেও সারাক্ষণ চলছে খেলার ঝলক। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, ট্রাফালগার স্কোয়ার, বেকার স্ট্রিট, টাওয়ার হিল, ওয়েস্টমিনস্টার যেখানেই যান না কেন একবারও মনে হবে না খেলাটা রাশিয়ায় হচ্ছে।
আমি জীবনে ইংল্যান্ডকে ফুটবলে সমর্থন করিনি, করার কথাও ভাবিনি। কিন্তু প্রবাসী হওয়ার পরে এদের দেশভক্তিকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারলাম না। আর সেটার তো একটা সাইড এফেক্ট আছেই। সেকেন্ড রাউন্ডে কলম্বিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ড যখন টাই-ব্রেকারে যাচ্ছে, তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি দেশটা হেরে যাক। বিশ্বাস করুন, সেটা কিন্তু এখানকার বাসিন্দা হওয়ার জন্য নয়।
প্রবাসী হওয়ার পরে এদের দেশভক্তিকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারলাম না [ছবি: রয়টার্স]
ব্রিটিশদের চালচলন, কথাবার্তা, স্মিত ব্যবহার দেখে আমার বরাবরই মনে হতো এদের ফুটবল দর্শকদের "হুলিগ্যান" কেন বলে। অথচ, আগে টিভিতে দেখতাম, ইংল্যান্ড হেরে গেলে কোনও দোকানের কাঁচ অবশিষ্ট থাকতো না, গাড়ি গুলোরও এক হাল হতো। কোথাও একটা কনস্ট্রাস্ট আছে. সেটা এখনও ধরতে পারিনি। সদ্য এক বছর হলো পরিবার সমেত এই দেশে এসে বসবাস করছি. আমাকে অনেকেই বলেছেন, এখন ম্যাচ জিতেছে, কোয়ার্টার ফাইনালে গেছে, এগুলো সব পজিটিভ সাইন। একবার হেরে যেতে দাও, তারপরে ট্রাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে থেকো। ব্রিটিশদের প্রতি ধারণা বদলে যাবে।
হয়তো সেটাই সত্যি. আঁখো দেখা হালের সুযোগ তো হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে যদি সুইডেনের কাছে হেরে যায়, তাহলে "ব্রিটিশ ফুটবল প্রেমের প্রতিহিংসার" একটা নমুনা দেখার চাক্ষুস সুযোগ হয়তো হতে পারে।
পিকচার সত্যিই বাকি হ্যায়।