শুধুই রসগোল্লা নয়, আরও অনেক খাবার নিয়েই লড়াই রয়েছে ভারতীয়দের মধ্যে

অন্য রাজ্যে রসগোল্লা শুধুমাত্র মিষ্টি হিসাবে খাওয়া হয় না

 |  5-minute read |   28-10-2018
  • Total Shares

বিতর্কটা ছিল কে রসগোল্লা আবিষ্কার করেছে তা নিয়ে – বাংলা নাকি ওড়িশা – সেই বিতর্ক আবার নতুন করে শুরু হয়েছে, আর বলতে পারি, এবার তা বেশ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে।

যাঁরা প্রাদেশিকতা খুঁজে বেড়ান তাঁদের কথা যদি ধর্তব্যের মধ্যে নাও আনা হয় তা হলেও যে প্রশ্নটি উঠছে তা হল কোনটা আগে এসেছে – লুচি নাকি পুরী?

লুচি এমন একটা খাবার যা বাঙালি মাত্রই খেতে ভালোবাসেন (অসমিয়ারা আবার এটিকে লুসি বলেন), এটি তৈরি হয় ময়দা থেকে, মানে ইংরেজিতে যাকে বলে রিফাইনড ফ্লাওয়ার। প্রাতঃরাশে আলুর দম অথবা ঘুগনি সহযোগে এটি খাওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে রবিবার ও জন্মদিনে লুচি খাওয়া হয় কষা মাংস সহযোগে। ঠাকুমা-দিদিমারা আবার সাদা আলুর তরকারি দিয়ে খেতে পছন্দ করেন। আলু ছোট চৌকো করে কেটে শুধুমাত্র কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে এই তরকারি রান্না করা হয়। আর স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বা চাকরিতে ঢোকার সময় মা যখন টিফিন গুছিয়ে দিতেন তখন আবার তার মধ্যে একটা রসগোল্লা দেওয়া থাকত। অনেক সময় চিনি দিয়েও আমরা লুচি খেয়েছি, কখনও মিষ্টি দইয়ে ডুবিয়েও খেয়েছি।

emb_luchi-poori_102818080633.jpgথালা ভরা আছে...: লুচি-আলুরদম এবং পুরী-আলু – এই দুই শব্দবন্ধের মধ্যে অর্থের অনেক পার্থক্য (ছবি: ডেইলিও)

অন্যদিকে পুরী বানানো হয় আটা দিয়ে, মানে ইংরেজিতে যাকে বলে হোল হুইট ফ্লাওয়ার। সারা ভারতেই এই খাবারটি সমাদৃত – উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম – সর্বত্র, শুধুমাত্র লুচির পীঠস্থান পূর্বভারত-টুকু বাদ দিয়ে। পুরী নানা মাপের ও নানা রকমের হতে পারে। উত্তর ভারতে পুরী মানেই সঙ্গে আলু কি সব্জি। মহাষ্টমী মানে হালুয়া সহযোগে পুরী। দক্ষিণ ভারতে পুরী খাওয়া হয় নিরামিষ কোর্মা দিয়ে। পশ্চিম ভারতেও পুরী খাওয়া হয় আলু কি সবজি দিয়ে, তা শুকনো শুকনো হতে পারে, আবার সামান্য মাখো মাখোও হতে পারে – আবার শ্রীখণ্ড অথবা আমরস সহযোগেও খাওয়া হতে পারে।

লুচি ও পুরী নিয়ে নিয়ে এই আলোচনার সঙ্গে এই দুই খাবার নিয়ে তর্কাতর্কির অবকাশ কোথায় আছে সেই প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন।

ঠিক আছে, যদি লুচি এবং পুরী দুটো আলাদা জিনিস হয়ে তাকে তা হলে রসগোল্লার ক্ষেত্রেও তাই, বাংলার রসগোল্লা ও ওড়িশার রসগোল্লা পুরো আলাদা দুটো জিনিস।

বাংলায় আমরা যে রসগোল্লা খাই তার মধ্যে স্পঞ্জ ভাব রয়েছে আর সেটা একেবারে সাদা রংয়ের, সাধারণ ভাবে সেটির পেটের মাঝখানটা ফাঁপা হয়।  

emb_sponge-ros_102818080704.jpgবাংলার রসগোল্লা হল সাদা, স্পঞ্জি ও ফাঁপা (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

ওড়িশার পহল রসগোল্লার যে সব ছবি আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছিল, সেগুলো দেখে মনে হয় গাঢ়, স্পঞ্জি নয় এবং অনেকটা মেটে মেটে রং।

একটা বাংলার, আরেকটা ওড়িশার।

আর এই দুটিই চরিত্রগত দিক দিয়ে অনন্য, এই দুটি মিষ্টি স্বাদেও আলাদা, দুই মিষ্টির আবেদনও আলাদা।

emb_odisha-inside_102818080734.jpgওড়িশার পহল রসগোল্লা অনেকটাই গাঢ় ধরনের (ছবি: পিটিআই/ফাইল)

কেউ এ কথা বলতেই পারেন যে খাবার হল আবেগের ব্যাপার, তাই এই সমস্ত যুক্তি-তর্ক সেখানে খাটে না। তবে এ ক্ষেত্রে সেটা খাটে।

সম্প্রতি আমি বাঙালি ও ওড়িয়াদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে আপনাদের সমস্যাটা কোথায়। কেন আপনারা দুই রাজ্যের লোক মিলে রসগোল্লাকে দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত খাবারে পরিণত করেছেন?

ও, আচ্ছা, তা আপনারা করেননি!

আমার এক বন্ধু যিনি খাবারদাবার নিয়ে লেখালিখি করেন তিনি একবার তাঁর প্রিয় খাবার ব্যাঙ্গালোরের দোসা নিয়ে একটি ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন – তারপরে চেন্নাইয়ের লোকজন তাঁকে নিদারুণ ভাবে বিদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল চেন্নাইয়ের দোসার মধ্যে যেটা থাকে সেটা কোনও দাগ বা প্যাচ নয়। সেই প্রতিবেদনটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল এবং তাতে বিপুল সংখ্যায় হিট হয়েছিল বলে স্বভাবতই সম্পাদক মহাশয় বেশ খুশি হয়েছিলেন। তবে ঘটনা হল এই দুই শহরে যে দোসা পাওয়া যায় তা একেবারেই ভিন্ন। আমার নিজের পছন্দ হল ব্যাঙ্গালোরের দোসা, কারণ সেটা বেশ মুচমুচে লাগে।

এবার সম্বরের রেসিপি নিয়ে লিখেছেন এমন কোনও ফুডব্লগারের কাছে অভিজ্ঞতার কথা জানতে চান, শুনবেন যে তাঁকে যেন বোমার আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছে আর তাদের মোদ্দা কথা হল লেখক কত ভুলভাল লিখেছেন। কেউ বলবেন যে ‘আমার ঠাকুমা তাতে গুড় ঢালতেন’, কেউ বলবেন যে ‘আমার মা তাতে ডাঁটা দিতেন’, কেউ বলবেন ‘আমাদের কুলপুরোহিত কোয়া পেঁয়াজ দিতেন না’, কেউ বলবেন ‘ব্রাহ্মণদের সম্বর ওই ভাবে তৈরি করে না’ – মতামতের বন্যা বইবে, আর বেচারি লেখক শুধু দেখতেই তাকবেন, কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না।

তরকারি নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন এমন একজন টেলিভিশন প্রযোজকের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা জানতে চান – তিনি যদি লিখে থাকেন যে তরকারি হল একটি ভারতীয় খবার এবং সেটিতে কোনও ঔপনিবেশিকতা জুড়ে নেই – লেখার জন্য শুধু তাঁকে মারতে বাকি রাখা হয়েছে – মারাত্মক মারাত্মক সব বিশ্লেষণ, সূক্ষ্ম বিচার এবং প্রশ্ন করা হবে যে খাবারটি দেখানো হচ্ছে সেটি আদৌ তরকারি তো!

কোনও একজন হায়দরাবাদিকে একবার বলার চেষ্টা করে দেখুন যে আপনি লখনউ অথবা কলকাতার বিরিয়ানি পছন্দ করেন, এ কথা বলার কী ফল হতে পারে সে জন্য তৈরি থাকবেন। তাঁরা বলবেন, “ওরে আহাম্মক, ওটা বিরিয়ানি নয়, পোলাও” আর দ্বিতীয়বার কোনও কথা বলার সুযোগ ওঁরা আপনাকে দেবে না।

emb_latest-inside_102818080805.jpg কোনও অবস্থাতেই এদের মেলানো যাবে না: ব্যাঙ্গালোর দোসা যাঁরা পছন্দ করেন এবং চেন্নাইয়ের দোসা যাঁরা পছন্দ করেন তাঁদের মধ্যে মস্ত পার্থক্য রয়েছে (ছবি: ডেইলিও)

জানেন কি কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরিয়ানি নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে অন্য সকলকে দমিয়ে রেখেছেন হায়দরাবাদীরা, আসলে দক্ষিণ ভারতে আরও বেশ কয়েক রকমের বিরিয়ানি আছে – স্টাটার হিসাবে কেরলে দেওয়া হয় মোপলা, চেন্নাইয়ে দেওয়া হয় ডিন্ডিগুল ও আম্বুর এমনকি হায়দরাবাদও আজকাল আরও বেশি আরবি-ধাঁচের মান্ডি রাইসের দিকে ঝুঁকেছে।

এখনও আপনারা বলবেন যে রসগোল্লা নিয়ে বিতর্ক সবেচেয়ে বেশি হয়েছে?

একবার আলফানসো আম খেতে ভালোবাসেন বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার লিখে দেখুন... আমি একবার লিখেছিলাম।

কাদেরটা ভালো তা নিয়ে গুজরাটি ও মারাঠীরা লড়াই বাধিয়ে ফেলবে। তারপরে উত্তরপ্রদেশের লোকজন সেই তর্কে যোগ দিয়ে বলবেন যে ল্যাংড়াই হল আমের রাজা। আমার এক বাঙালি বন্ধু লিখলেন, “আপনি কী ভাবে অমন সুন্দর হিমসাগরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারলেন?” তার ওই কথার মধ্যে একটা নেতিবাচক ব্যঞ্জনা ছিল। গোয়ার লোকজন আর দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দারা বাঁকা হাসি হেসে তাদের এলাকায় যে সব অগণিত স্থানীয় আম পাওয়া যায় সেগুলোই খেতে থাকলেন, এ নিয়ে আদৌ কোনও কথা বলার দরকার আছে বলে তাঁরা মনে করেন না।

সত্যিই, ভারতীয়রা খবারের ব্যাপারে ভীষণ ভাবেই আবেগপ্রবণ।

তাই এ দেশের খাবার এত সুন্দর এবং এ দেশে এত রকম খাবার পাওয়া যায়।

তাই কাবার নিয়ে আমাদের লড়াইটাও একেবারে সেই কারণেই।

যখন এ সব নিয়ে তর্কাতর্কি একেবারে আমাদের হাতের বাইরে চলে যায় তখন একটা কথাই বলতে পারি যে খোলা মনে এই বৈচিত্র্য অনুভব করুন, একমাত্র এটাই আপনাকে দারুণ সব খাবারের স্বাদের সন্ধান দিতে পারে, সেই সব খাবার আস্বাদন করুন আর আরও বেশি করে বন্ধুত্ব পাতান।

সর্বদাই খেতে থাকুন।

আমার কথা বলতে পারি, রসগোল্লা নিয়ে এতসব বিতর্কে একটা মাত্র আবেগই কাজ করেছিল। পহল রসগোল্লা থেকে তখন আমার খুব ওড়িশা যেতে ইচ্ছা করছিল। আর ছানাপোড়াও খেতে ইচ্ছা করছিল, আমি এখন সেটাই খাচ্ছি।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

KALYAN KARMAKAR KALYAN KARMAKAR @finelychopped

He is obsessed with food | Runs an award-winning food and travel blog www.finelychopped.net

Comment