মধ্যবিত্তরা কেন আসারামের মতো আধ্যাত্মিক বাবাদের খুঁজে বেড়ান
এই সমাজে গুরুদেব মানে অনবদ্য একটা পণ্য: যা মানানসই, একই সঙ্গে টেঁকসই
- Total Shares
ভারতীয় সমাজে ধর্মগুরু মানেই একটি অনবদ্য পণ্য। একই সঙ্গে টেঁকসই ও মানানসই। যে কোনও হাল ফ্যাশনের আইফোনের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে।
এই গুরুদেব যদি একবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যান, তা হলে অচিরেই তিনি ভারতীয় সমাজের মাথা হয়ে ওঠেন। খুব দ্রুততার সঙ্গে তিনি অগাধ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে যান। ক্ষমতাবলে তিনি সহজেই প্রথাগত রীতিনীতিকে ভেঙে দিতে পারেন, নিষিদ্ধকে সিদ্ধ করতে পারেন এবং যখন তখন যৌন সংসর্গ উপভোগ করার ছাড়পত্র পেয়ে যেতে পারেন। তাঁর শিষ্যরা তো তাঁর হাতের পুতুল। তিনি শুধু তাঁদের কে কী ভাবে খেলতে হয়, তার পথ বাতলে দেন।
ভাবেন না অন্য কোনও রকম ব্যবসার থেকে এই ধর্মীয় ব্যবসাটি খুব সহজ। আপনাকে যথেষ্ট প্রতিভাবান হতে হবে এই ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে।একই সঙ্গে মার্কেটিং সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে। দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি আপনি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যাবেন। মানুষের ধর্মই একসঙ্গে থাকা। ফেসবুকেই দেখুন-- পরিচিত কেউ যদি আপনার পোস্টটি পছন্দ করেন অনেক অপরিচিতরাও 'লাইক' ঠুকে দেন। সবাই চেষ্টা করছে এমন একটা ছাতার তলায় থাকতে যেখানে আরও অনেকে আগে থেকেই উপস্থিত রয়েছেন। ধর্মগুরুর ব্যবসাও এই একই ফর্মুলা মেনে চলে।
'বাবার' বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু হলে বা 'বাবা' জেলে গেলে ভক্তরা গন্ডগোল পাকাতেও সিদ্ধহস্ত
তা এই গুরুদেবদের মতো এত বুদ্ধিমান প্রজাতি আপনি খুব একটা পাবেন না। এই গুরুদেবরা সব সময় সাধারণ মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। তাঁর ভক্তরা তাঁর জন্য জীবন দিতে পারেন। শুধু তাই নয় 'বাবার' বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু হলে বা 'বাবা' জেলে গেলে রাস্তায় নেমে গন্ডগোল পাকাতেও সিদ্ধহস্ত তাঁর ভক্তরা। মজার বিষয়, এই সব কিছুই 'বাবাকে' কেন্দ্র করে হবে কিন্তু স্বয়ং গুরুদেব স্বয়ং এই বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত থাকবেন না।
আর, আপনি যদি প্রথম সারির গুরু হন তা হলে তো সোনায় সোহাগা। দেশের উচ্চবিত্তরা আপনার পদতলে। কে থাকবেন না এই তালিকায় ? ক্রিকেটার, রুপালি পর্দার নক্ষত্ররা, রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সংবাদমাধ্যমের কেষ্ট বিষ্টুরা মায় বিভিন্ন পেশার উদীয়মান তারকারা। এঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের হালহকিকত গুরুদেবের নখদর্পনে।
এই গুরুদেবরা অনন্য। তাঁরা প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে কথা বলেন। খুবই হিসেবে করে আপনাকে আপনার পছন্দ মতো স্বাধীনতা দেন। কিন্তু সমস্যা একটাই। রাজনৈতিক নেতাদের মতোই ইনিও কিন্তু আপনাকে ব্যবহার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করেন। এই গুরুকুল কিন্তু কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে। মহিলা, পুরুষ, স্বদেশী বিদেশি সবাই এই কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারেন।
এই ধরণের গুরুদেবরা কিন্তু যথেষ্ট ফ্যাশন সচেতন। মহিলা সাধ্বীরা রীতিমতো দামি ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তাও আবার বিলাসবহুল গাড়িতে। পুরুষ সাধুরাও কম যান না। তাঁদের প্রয়োজন পপ গানের ভিডিও, দামি স্পোর্টস বাইক ও আরও অনেক কিছু। এঁদের কেউই গেরুয়া বসন গায়ে জড়িয়ে সাধু সেজে ঘুরে বেড়ান না। তাঁরা যে জাস্টিন বেইবারের থেকেও 'বড় কেউ' তা জানাতেও কোনও রকম ত্রুটি রাখেন না। নিঃসন্দেহে, এক কথায় এনাদের আপনি 'পুঁজিবাদী গুরুদেব' বলে সম্বোধন করতেই পারেন।
এই ধরণের গুরুদেবরা কিন্তু যথেষ্ট ফ্যাশন সচেতন
এ দেশের প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি করে গুরুদেব পাবেন, অনেকটা ঘরের আসবাবের মতো। বিবাহ থেকে শুরু করে জমি বাড়ি কেনাবেচা সব কিছুই এই গুরুদেবের পরামর্শ মেনেই চলেন। আমাদের দেশের সমাজ কোনও একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নন। গোটা একটা পরিবারকেই এই সমাজে একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। আপনার নিজস্ব মতামত পোষণ করতে গেলেও আপনাকে আপনার পরিবারের মাধ্যমে করতে হবে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার পারিবারিক গুরুর মতামতটাই আপনার পরিবারের মতামত। এই ব্যবস্থাটা কিন্তু পুরোপুরি ভাবে ব্যবসায়িক। তাই গুরুদেব সদা প্রস্তুত থাকেন আপনাকে পরামর্শ দিতে।
এবার বিদেশে যাওয়া যাক। এই গুরুকুল ব্যবস্থা ইউরোপে না থাকলেও আমেরিকাতে বহুল প্রচলিত। যুক্তরাষ্ট্রে গুরুদেবদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকে শিষ্যদের। আসলে, ঈশ্বর তো রক্ত মাংসে গড়া নয়, তাই প্রতিটি মানুষের একজন করে ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় যিনি রক্ত মাংসে গড়া। মানুষ মাত্রই অলস, মানুষ মাত্রই কুসংস্কারচ্ছন্ন। গুরুর প্রতি ভক্তি থাকা মানেই আপনি জীবনের বেশ কিছু দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন।
ভ্রান্ত ধারণা হলেও এই ধারণাই আমাদের মনে বদ্ধমূল - আধ্যাত্মিক জগতে আমার আপনার থেকে বেশি ক্ষমতাশালী এমন কাউকে ধরে রাখতে পারলে আমার আপনার উন্নতি ঠেকায় কে?