রামমন্দির: কংগ্রেস ও চক্রান্তকারীরা কী কী নতুন পন্থা অবলম্বন করছে
এরকম একটা গুরত্বপূর্ন মামলার নিষ্পত্তি করতে সুপ্রিম কোর্টের এতটা বিলম্ব হচ্ছে কেন
- Total Shares
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ভগবান রাম কি বিজেপিকে রক্ষা করতে পারবেন?
অযোধ্যার মন্দির-মসজিদ চত্ত্বরে ৬৭ একর জমি ছেড়ে দেওয়ার যে আবেদন নরেন্দ্র মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে করেছে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা মামলার শুনানি প্রক্রিয়া উত্তোরত্তর বিলম্বিত হয়ে চলার জন্য বিজেপির হিন্দুত্ব ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পেরে মোদী সরকার দুটি লক্ষ নিয়ে এই নয়া পন্থা অবলম্বন করেছে - এক, তাদের প্রতি বিশ্বাসীদের তোষণ করা; দুই, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে এই মামলার রায়দান অসম্ভব বলে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার বন্ধ ধমনীগুলোকে বাইপাস করে যাওয়া।
মন্দির-মসজিদ চত্ত্বরের ৬৭ একর জমি ছেড়ে দেওয়ার আবেদন করেছে সরকার [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
সরকারের এই নতুন পদক্ষেপকে লাইনচ্যুত করতে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের প্রতিনিধিরা কিন্তু মরিয়া চেষ্টা চালাবেন।
লোকসভা নির্বাচনের আগে অযোধ্যা মামলার রায়দান হয়ে যাক তা অনেক বিরোধী দলও চায় না। এই রায় যদি 'হিন্দুদের' জন্য ইতিবাচক হয় তাহলে লোকসভা নির্বাচনে তার ফায়দা লুটবে বিজেপি। উল্টোদিকে, লোকসভা নির্বাচনের পর যদি আদালত রায়দান করে তাহলে শাসক দল কিন্তু নির্বাচনে বেশ ফাঁপরে পড়ে যাবে।
তা সত্ত্বেও সরকার এই নতুন পদক্ষেপ - যার অনেকটাই প্রতীকী - নিয়েছে বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করার জন্যে।
ইচ্ছাকৃত দেরি
মূল মামলাটিকে ইচ্ছেকৃত ভাবে জটিল করা হয়েছে যাতে মামলার রায়দান খুব সহজেই বিলম্বিত করে দেওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চকে এখন অষ্টাশিজন সাক্ষীর দেওয়া কুড়ি হাজার পাতা বিশিষ্ঠ জবানবন্দি পড়ে দেখতে হবে। এর মধ্যে আবার পারস্য, সংস্কৃত, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও গুরুমুখী ভাষায় লেখা দস্তাবেজ রয়েছে - যেগুলোকে সবার আগে ইংরেজিতে অনুলিখন করতে হবে।
মামলাটিকে আরও জটিল করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চকে এখন ১২০টি বিষয়সমূহ ১৪টি আবেদনের শুনানি করতে হবে। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ের আইনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে যার মীমাংসা করতে আদালতের মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে।
চার প্রবীণ বিচারপতি একযোগে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন [ছবি: আজতক]
এই লক্ষ্যেই এলাহাবাদ হাইকোর্টের মূল মামলার রায়কে সুপ্রিম কোর্টে এইভাবে চ্যলেঞ্জ জানিয়েছেন আবেদনকারীরা। এলাহাবাদ মামলার রায় যদি সুপ্রিম কোর্টও মেনে নেয় তাহলে রামমন্দির মামলার শুনানি হতে বাধ্য।
রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে যে আইনি প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টে চলেছে তা আটকাতে কংগ্রেস বাম ও এআইএমএমের মতো ইসলামিস্ট দলগুলো বহুদিন ধরে চেষ্টা করে চলেছে। লোকসভা নির্বাচনে এই রায়ের মূল্য কী হতে পারে তা তারা বিলক্ষণ জানে। তাই তো এই প্রক্রিয়া রুখে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত বিভিন্ন ধরণের পন্থা অবলম্বন করা হয়ে চলেছে।
প্রথমে, পছন্দসই সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সালে অভিযোগ তোলা হল যে বিচারপতি বিএইচ লোয়ার হৃদরোগে মৃত্যু হয়নি, বরঞ্চ সোহরাবউদ্দিন শেখ মামলা থেকে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে রক্ষা করতে এই বিচারপতিকে ছক কষে খুন করা হয়েছে। এই পন্থা অবলম্বনের ফলে দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অযোধ্যা মামলার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেন না।
এর পর ২০১৮ সালে কলেজিয়ামের চার সদস্য সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ তোলেন যে বিচারপতিদের এজলাসে আইন মোতাবেক মামলা বরাদ্দ করছেন না বিচারপতি মিশ্র (পরবর্তীকালে অবশ্য বর্তমান প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নিজেই স্বীকার করেছেন যে এ বিষয়ে একমাত্র প্রধান বিচারপতিই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন)। কিন্তু চার প্রবীণ বিচারপতির এহেন আচরণে রামমন্দির মামলা প্রক্রিয়া অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবার চক্রান্তকারীদের অস্বস্তিতে ফেলেছেন [ছবি: পিটিআই]
এর পরেই আইনজীবী, রাজনিতীবিদ এবং পেশাদার জনস্বার্থ মামলাকারীরা একযোগে প্রধান বিচারপতিকে চাপে রাখার জন্যে তাঁর অপসারণ দাবি করেন। এই অপসারণ প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ারই ছিল। কিন্তু অভিযোগকারীদের মূল লক্ষ ছিল চাপে ফেলা, এবং, তাতে তাঁরা কিছুটা হলেও সফল হয়েছিলেন।
এই তিন পন্থা অবলম্বন করে একটা জিনিস নিশ্চিত করা গিয়েছিল - অযোধ্যা মামলার রায়দান যেন কোনও ভাবেই মিশ্রের মেয়াদকালের আগে না হয়। ২০১৮ সালের দোসরা অক্টোবর প্রধান বিচারপতি হিসেবে মিশ্রের মেয়াদকাল শেষ হয়েছে।
কংগ্রেসের আইনজীবী দলের সাহায্যে লক্ষ পূরণ করা গেল। আর, ২০১৮ সালের দোসরা অক্টোবরের পর থেকে বিচারপতি লোয়ার হত্যা রহস্য নিয়ে আর একটিও শব্দ খরচ করা হল না। চার বিচারপতি যে অভিযোগ তুলেছিলেন তাও সকলে ভুলে গেলেন। অপসারণ প্রক্রিয়াও আর কার্যকর করার প্রয়োজন পড়ল না।
স্বাধীন চিন্তাধারা
বিচারপতি মিশ্রের বিরুদ্ধে যারা একটা সময়ে বর্তমান মুখ্য বিচারপতি গগৈকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁদেরকে পরবর্তীকালে বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন বিচারপতি গগৈ।
অযোধ্যা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষে তিনি এ বছরের ১০ জানুয়ারী মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছিলেন। এই বিশ্বাঘাতকতায় অবাক হয়ে চক্রান্তকারীরা আবার খুব দ্রুত মাঠে নেমে পড়লেন।
মুখ্য বিচারপতি গগৈয়ের সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বধীন বেঞ্চ রাফেল ও সিবিআই কাণ্ডে যে রায়দান করেছিল তাকে প্রমান হিসেবে দেখিয়ে বিচারপতি গগৈয়ের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে 'তোষণ' করার অভিযোগ আনা হল।
মিশ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যিনি হিরো ছিলেন সেই বিচারপতি গগৈই এখন ভিলেনে পরিণত হলেন। চক্রান্তকারীরা নিশ্চিত করলেন যাতে বিচারপতি ইউ ইউ ললিত, যিনি এককালে (আইনজীবী থাকাকালীন) উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের হয়ে মামলা লড়েছিলেন, যেন এই রামমন্দির মামলাটি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নেন। এর ফলে এই মামলা আরও বিলম্বিত হল। নতুন বেঞ্চ তৈরি করতেম করতে মামলার পরিবর্তী শুনানির দিনও, ২৯ জানুয়ারী, পেরিয়ে যাবে।
কংগ্রেস কেন অযোধ্যা মামলা নিয়ে এতটা ভীত?
The @firstpost-CNBC-TV18 National Trust Survey | Majority in Andhra Pradesh, Tamil Nadu & Kerala give the PM's performance a low rating#FirstpostTrustSurvey pic.twitter.com/l16GnEedr1
— CNBC-TV18 (@CNBCTV18Live) January 25, 2019
তার কারণ এই মামলার প্রভাব কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরও থেকে যাবে। সংবাদমাধ্যমের একটি গণনায় দেখা গিয়েছে যে গণনায় ৩৪,০০০ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৭৪.৩ শতাংশ লোক ই মনে করছেন যে ২০১৯ লোকসভায় এই মামলা এই বড় ইস্যু হয়ে উঠবে।
সরকার যে ৬৭ একর জমি ছেড়ে দেওয়ার আবেদন করেছে সেই আবেদন আদালত মানুক বা না মানুক রামমন্দির তৈরি হতে কিন্তু বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। সরকারের আবেদন অনুযায়ী, এই ৬৭ একর জমি যেন জমির সত্যিকারের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার মধ্যে রাম জন্মভূমি নয়াসও (রাম জন্মভূমিকে প্রচার ও রামমন্দির তৈরির কাজ তদারকির জন্য যে সংগঠন গঠন করা হয়েছে) রয়েছে।
এর ফলে, যৌথভাবে কংগ্রেস,বাম ও ইসলামিস্টদের ভোটবাক্সে দীর্ঘকালীন প্রভাব পড়তে পারে।
রাম মন্দির মামলা কিন্তু রাহুল গান্ধীর অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে [ছবি: পিটিআই]
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বর্তমানে বেশ জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
তিনি নতুন করে ব্রাহ্মণ হয়েছেন। তাই তিনি খোলাখুলি রামমন্দিরের বিরোধিতা করতে পারছেন না। কিন্তু, তিনি এও জানেন, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হলে তা সর্বসম্মতভাবে বিজেপিকেই সাহায্য করবে।
তার মানে, রামমন্দির ইস্যু কিন্তু রাহুল গান্ধীর অস্তিত্ব রক্ষাকে চ্যলেঞ্জ করছে। তাই বিচারপতি গগৈকে সমালোচিত করা আগামী কয়েক সপ্তাহে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। এই চেষ্টা কিন্তু লোকসভা নির্বাচন শেষ হলেই শেষ হবে না। যতদিন না অযোধ্যা মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন এই চেষ্টা চলতেই থাকবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে