জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে এক অবসরপ্রাপ্ত মুসলমান সেনা আধিকারিকের বার্তা
জঙ্গিরা কোনও মতেই মুসলমান নয়, কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ কোনও মতেই ধর্ম নয়
- Total Shares
১৪ ফেব্রুয়ারি রাত জুড়ে আমি চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পুলওয়ামাতে সিআরপিএফের কনভয়ের উপর হামলার খবর পাওয়ার পর থেকেই আমার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল।
একটি ভিডিয়ো দেখে আমি যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। সেই ভিডিয়োতে এক সন্ত্রাসবাদকে দেখা যাচ্ছে। এই সন্ত্রাসবাদ দাবি করছে যে, 'জিহাদ' ও ইসলাম ধর্মের জন্য আত্মঘাতী হামলায় নিজেকে উড়িয়ে দিতে পারলে তার 'জন্নতে' জায়গা হবে। এই দাবি যে নিছকই 'বোকা বোকা' তা বলাই বাহুল্য।
এই কাপুরুষরা কী ভাবে নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করতে পারে?
আমার নাম মেজর মহম্মদ আলি শাহ (বড়)।
প্রায় ২০০ বছর ধরে আমার পরিবারের সদস্যরা সৈনিকের জীবন যাপন করে চলেছে। আমার পূর্বপুরুষরা দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধেও লড়েছেন। আমার বাবা জামির উদ্দিন শাহ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক যিনি আবার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে বিভিন্ন কারণে আমার পরিবার পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই মাটিতেই আমাদের জন্ম, ভারতবাসী হতে পেরে আমরা গর্বিত। পাশাপাশি আমরাও হজে তীর্থযাত্রা করে এসেছি।
এই কাপুরুষরা জানে না যে ইসলাম ধর্ম কখনোই নিরপরাধ লোকেদের হত্যার কথা বলে না।
পুলওয়ামার বিস্ফোরণ স্থল [ছবি: রয়টার্স]
এই জঙ্গিরা আদতে ইসলাম-বিরোধী কাজ করে চলেছে যার ফলে ইসলাম ধর্মের অবমাননা হচ্ছে। আর এই জন্য মুসলমানদের একটি বিশেষ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।
হিন্দি সিনেমায় দেখবেন এক শ্রেণীর লোকেদের ভিলেন করা হয়। হলিউডে দেখবেন কোনও একটি বিশেষ দেশের লোকেদের ড্রাগ চোরাকারবারি হিসেবে দেখানো হয় আবার অন্য একটি দেশের নাগরিকদের মাফিয়া ডন হিসেবে দেখানো হয়। ঠিক সেই ভাবেই, বাস্তবে সন্ত্রাসবাদী বলতে শুধুমাত্র একটি ধর্মাবলম্বী লোকেদের কথাই বলা হয়ে থাকে।
সেনাবাহিনী পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি আমার বাবাকে নব্বইয়ের দশকে পঞ্জাবে এবং এর পরে উত্তরপূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে দেখেছি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কাশ্মীর ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে মুসলমান ও অ-মুসলমান সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে বহু সময়তেই আমি নিজের জীবন বিপন্ন করেছি। দুর্ভাগ্যবশত কয়েকজন অজ্ঞ লোকের জন্য, যারা কিছু না জেনেই 'জিহাদ' 'জিহাদ' করতে থাকে, তাদের জন্য ইসলামের উপর সন্ত্রাসবাদের তকমা পড়ে গিয়েছে।
আমার বাবা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ে তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের প্রচেষ্টার ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় টাইমস হায়ার এডুকেশনের বিচারে দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
কিন্তু কয়েকজন মৌলবাদীর নির্বুদ্ধিতার জন্য, যারা নিজেদের 'ইসলামিস্ট' বলে দাবি করে, এই বিশ্ববিদ্যালয়কেও কলঙ্কিত হতে হয়েছে কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে 'মুসলিম' শব্দটি রয়েছে। আমার বাবার আত্মজীবনীর নাম 'দ্য সরকারি মুসলমান' যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেই বইটি নিয়েও অনেকে ভুল বুঝেছিলেন কারণ বইটির নামে 'মুসলমান' শব্দটি রয়েছে বলে।
সন্ত্রাসবাদীদের কুকর্মে মুসলমানদের ভালো কাজ চাপা পড়ে যাচ্ছে [ছবি: রয়টার্স]
বাস্তবে ইসলাম কিন্তু একটি শান্তি প্রিয় ধর্ম যা ঐক্যের কথাই বলে থাকে। সন্ত্রাসবাদীরা যে কথা বলে তা কিন্তু ইসলাম শেখায় না। ইসলামের বাণী আর সন্ত্রাসবাদীদের প্রচারের মধ্যে তফাৎ এতটাই যে আমি সন্ত্রাসবাদীদের মুসলমান বলে মনেই করি না।
তারা সত্যি সত্যিই সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসই, আর কোনও ধর্মই সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না।
'জিহাদ' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে 'সংগ্রাম'। কিন্তু জৈশ-ই-মহম্মদের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সৌজন্যে তা এখন অ-মুসলমান ধর্মগুলোর উপর অত্যাচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সন্ত্রাসবাদীদের কুকর্মের জন্য মুসলমানদের 'ভালো কাজগুলো' চাপা পড়ে যাচ্ছে। বুঝতে হবে, এই সন্ত্রাসবাদীরা কিন্তু মনুষ্যত্বের শত্রু ভিন্ন আর কিছুই নয়।
এই সন্ত্রাসবাদীরা আত্মঘাতী হামলাকারীদের পালন করে চলেছে - যারা শুধুমাত্র নরকেই পচতে পারে, জন্নতে তাদের কোনও প্রবেশাধিকার নেই।
অস্ত্র তুলে নিয়ে নিরাপরাধ লোকেদের হত্যা কী ভাবে কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে? জৈশ বা এই ধরণের অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি আসলে ইসলামে বিশ্বাসী নয়।
আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কেও কলঙ্কিত হতে হয়েছে কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে 'মুসলিম' শব্দটি রয়েছে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
পুলওয়ামাতে ভয়াবহ আক্রমণ করা জৈশ জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে আমার খোলা চিঠি লেখার কারণ একটাই। আশা করা যায় সেই চিঠি পড়ে আর কোনও তরুণ যেন তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই সংগঠনে যোগ না দেন।
এই চিঠি যেন জৈশ জঙ্গিদের হাতে পৌঁছায়। আর এই চিঠি পড়ে যেন তাঁদের মনে কোনও পরিবর্তন আসে।আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি নিজেদের পরিবর্তন না করতে পারি তা হলে সমাজেরও কোনও পরিবর্তন আসবে না।
জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে জঙ্গিদের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ ধর্ম নয়, মূল কারণ বেকারত্ব। কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণদের সহজেই সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে।
একমাত্র শিক্ষা ও কর্মসংস্থান এই সন্ত্রাসবাদ সমস্যার পাকাপাকি সমাধান করতে পারে। বন্দুক ও নিরাপত্তাবাহিনী দিয়ে শুধুমাত্র সাময়িক ভাবে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা সম্ভব - একজন জঙ্গিকে হত্যা করুন, দেখবেন তার জায়গায় আরও দশজন জঙ্গি তৈরি হয়ে গিয়েছে।
এই তরুণদের মন জয় করতে পারলেই সন্ত্রাসবাদ সমস্যার পাকাপাকি সমাধান সম্ভব।
মুসলমান হিসেবে আমি গর্বিত, ভারতবাসী হিসেবেও আমি গর্বিত।
এর কারণ আমি শুধুমাত্র সুশিক্ষা পাইনি, আমি ইসলাম ধর্মকেও খুব ভালো ভাবে বুঝি। ইসলামের নাম নিয়ে আমি সকলের কাছে শান্তির আহ্বান জানাচ্ছি।
একটা কথা বুঝতে হবে, পুঁথিগত শিক্ষা আর সুশিক্ষিত হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। জঙ্গিরা অশিক্ষিত তা সে যতই তাদের অনেকের উচ্চশিক্ষা থাকুক না কেন।
কাশ্মীরের প্রধান সমস্যা ধর্ম নয়, শিক্ষার অভাব ও বেকারত্ব [ছবি: পিটিআই]
তাদের বুঝতে হবে তারা ক্রমাগত একটি শান্তিপ্রিয় ধর্মকে হেয় করে চলেছে। পাশাপাশি ধর্মের নামে মনুষ্যত্বকেও হেয় করে চলেছে।
আমি তাদের সকলকে একটাই কথা বলব, "ইসলামের নামে আপনারা কলঙ্ক"।
জঙ্গি সংগঠনগুলোর বোঝা উচিত তারা ইসলামের ক্ষতি করে চলেছে।
মার্টিন লুথার কিং একবার বলেছিলেন, "অন্ধকার কোনও ভাবেই অন্ধকার ঘোচাতে পারে না; একমাত্র আলোই আঁধার দূর করতে পারে। বিদ্বেষ কখনওই বিদ্বেষ মেটাতে পারে না। একমাত্র ভালোবাসাই পারে বিদ্বেষ মেটাতে।"
আরও একটি বিষয় রয়েছে -- মুসলমানরা নাকি বড্ড বেশি কুসংস্কারছন্ন।
আমি মানছি মুসলমানদের মধ্যে প্রচুর কুসংস্কার রয়েছে, কিন্ত কুসংস্কার তো শুধুমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই নেই। যাদের শিক্ষা কম বা যারা দুর্বল তারা সকলেই কমবেশি কুসংস্কারচ্ছন্ন। আমাকে মানতেই হবে যে ভারতের মুসলমানরা শিক্ষাগত দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। আর তা থেকেই সমস্ত সমস্যার সূত্রপাত।
এর থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় রয়েছে - পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
খাবারের খরচ বাঁচান, শুধু ডাল-ভাত খেয়ে থাকুন, কিন্তু সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলুন।
সন্তানরা যদি শিক্ষিত না হয় তা হলে তারা ভালো চাকরি পাবে না। আর তারা যদি ভালো চাকরি না পায় তা হলে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে পারবে না। আর, এই ধারা চলতেই থাকবে।
মুসলমানরা যদি অশিক্ষিত ও বেকার রয়ে যায় তাহলে আমাদের সম্প্রদায়কে বরাবরই এক ঘরে করে রাখা হবে।
শিক্ষা মানে আমি শুধু পুঁথিগত শিক্ষার কথা বলছি না। সন্তানদের মনোভাবকেও সঠিক পথে চালিত করতে হবে।
যারা শিক্ষিত তারা সর্বত্র পূজিত হন।
পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, সকল ভারতবাসী যদি জাতি ধর্মের বিদ্বেষ ভুলে এক হয় তাহলে আমাদের ভারত একদিন সত্যিই সর্বশক্তিমান হয়ে উঠবে। ভারত যে একদিন সর্বশক্তিমান হয়ে উঠবে সে বিষয়ে আমি অন্তত স্থির বিশ্বাসী।
জয় হিন্দ!
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে