অবিচ্ছেদ্য কাশ্মীরে যদি রক্তপাত হয় তাহলে গোটা দেশ কী ভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারে
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গটি কী? কাশ্মীরের ভূমি নাকি সেখানের বাসিন্দারা?
- Total Shares
কাশ্মীর নিয়ে যখনই কোনও বিতর্ক দানা বাঁধে তখনই দেশের রাজনৈতিক নেতারা ও সরকার একটি কথাই বলে থাকে - কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের গণতন্ত্রের পীঠস্থানে, অর্থাৎ ভারতের সংসদ ভবনে, এই কথাটি বলা হয়ে থাকে। আর, বাকি সর্বত্রই এই কথাটির পুনরাবৃত্তি শোনা যায়।
এই কথাটি শোনার পরে আমার মনে স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্নের উদয় হয় - অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মানে কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় অঙ্গকেই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলা হয়ে থাকে। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ - কাশ্মীরের মাটি, নাকি কাশ্মীরের নাগরিক?
গত ১৫ ডিসেম্বর রক্তস্নানের সাক্ষী থেকেছে উপত্যকা। নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে পুলওয়ামাতে সাতজন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত ২৪ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
পুলয়ামা সংঘর্ষে সাতজন নিহত ও আরও ২৪জন আহত হয়েছেন [ছবি: রয়টার্স]
খবরের প্রকাশ, এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই ওই এলাকায় নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময়ে চলাকালীন তিন জঙ্গি ও একজন সেনাবাহিনীর জওয়ানের নিহত হয়েছিল। এর পরেই স্থানীয়রা এলাকায় জমায়েত করলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেই সেনাবাহিনী নিরপরাধ নাগরিকদের উপর গুলি চালায়।
অর্থাৎ, একই দিনে ঘটা এই দু'টি ঘটনায় সবমিলিয়ে ১১জনের জীবনহানি হল।
মৃত্য নাগরিকদের মধ্যে একজন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রও ছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে তার শবদেহ শনাক্ত করা যায়নি। পরে তার বাবা হঠাৎই হাসপাতালের শয্যায় তাঁর পুত্রের নিথর দেহ লক্ষ করেন।
দুর্ঘটনায় নিহত আরেকজন তরুণ এমবিএ স্নাতক। তিনি সবেমাত্র বিদেশিনী স্ত্রী ও তিন মাসের সন্তানকে সঙ্গে করে দেশে ফিরেছিলেন।
তার দেশ বেশ কয়ে ঘণ্টা ধরে সনাক্ত করা যায়নি [সৌজন্যে: টুইটার]
সেই অভিশপ্ত শনিবার রাত্রে মৃত ওই সাত পরিবারের সদস্যকেই এ ধরণের মর্মস্পর্শী অনেক কথাই শোনানোর ছিল। তাদের দুঃখ-বেদনা গোটা রাজ্যই যেন উপলব্ধি করতে পারছিল। শুধুমাত্র যাঁরা কাশ্মীরকে 'ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ' হিসাবে সম্বোধন করে থাকেন তাঁদেরই সেদিন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
দেশের কোনও শীর্ষ নেতাই কাশ্মীরের সেদিনকার ঘটনা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একটি টুইটও চোখে পড়েনি। মৃতদের পরিবারবর্গকে সমবেদনা জানানোর প্রয়োজনও কেউ উপলব্ধি করেননি।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। এই সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র এই রক্তপাত আর সংঘাতের রোজনামচা। শুধুই সংখ্যা যা প্রতিদিন নথিভুক্ত করতে হয়। আর রেকর্ড বইয়ে এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়তে থাকে। সাতজন নিহত হয়েছেন - এই তথ্য শুধুই সংখ্যা ভিন্ন আর কিছুই নয়।
উল্টোদিকে, সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যু নিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। পাল্টা যুক্তি দেখানো হয়, "তাঁদের মৃত্যু হয়েছে, কারণ তাঁরা সেই সময়ে ওই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।" সরকারি বিবৃতিতে অনেক সময়েই লেখা হয়ে থাকে, "মানুষের মৃত্যু ঘটেছে কারণ তাঁরা নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে সেই স্থানে জমায়েত করেছিলেন।"
সকল মৃতের পরিবর্গের মনেই মর্মস্পর্শী ঘটনা জমে রয়েছে [ছবি: পিটিআই]
এটা সত্যি যে যেখানে গুলি বিনিময়ে চলছে সেই স্থানে সাধারণ লোকেদের যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ভারতীয় সেনবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকরাও জানেন, কাশ্মীরে তা এত সহজে সম্ভব নয়।
২০১৮ সালে দু'শোর বেশি জঙ্গি উপত্যকায় নিহত হয়েছে। কিন্তু তার পাশাপাশি প্রায় শ'খানেক নিরীহ মানুষেরও মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে, যে জায়গায় গণ্ডগোল চলছে সেই জায়গায় গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ৪০ জন। এই সংখ্যা থেকেই তো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যাঁরা মারা গিয়েছেন, যে কারণেই তাঁদের মৃত্যু হয়ে থাকুক না কেন, তাঁদের জীবন তো মূল্যবান ছিল! এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করা উচিত ছিল।
কিন্তু তার বদলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকরা নীরব থাকতেই পছন্দ করেছেন।
আর এখান থেকেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদয় হয়েছে - মানুষের জীবনহানি এতটা স্বাভাবিক হতে পারে কী ভাবে?
এই ঘটনাগুলোর পরেও গোটা দেশ যে ভাবে উদাসীন রয়েছে তাতে কিন্তু 'অবিচ্ছেদ্য' শব্দটির অর্থ নিয়েই প্রশ্নের উদয় হচ্ছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে