বর্ষাকালে অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি দিলে নষ্ট হবে বাস্তুতন্ত্র, হতে পারে বিপর্যয়
মানুষ ঢুকলে বণ্যপ্রাণীদের যে স্বাভাবিক আচরণ অর্থাৎ মিলন ও শৈশব তা ভীষণ ব্যাহত হয়
- Total Shares
আমাদের দেশে ১৬ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর অবধি তিন মাস দেশের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও ব্যাঘ্রপ্রকল্প প্রভৃতি পর্যটকদের জন্য বন্ধ রাখা হয়। বন্ধ রাখার সবচেয়ে যেটি বড় কারণ, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর বর্ষাকাল হল অরণ্যের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়।
কেন এই সময়ে বন্ধ রাখা হয় এই সব অরণ্য এবং বর্ষাকালের গুরুত্ব কী তা বিষদে জানা দরকার। ভারতে যত উপমহাদেশীয় পাখি বা রেসিডেন্সিয়াল পাখি রয়েছে, সেই সব পাখির ৯৫ শতাংশেরই প্রজননের সময় হল বর্ষাকাল। স্বভাবতই এই সময়টিই তাদের সদ্যোজাতকে লালনপালন করার সময়ও বটে। এই সময় বনের স্বাভাবিক বাসিন্দা নয় এমন কেউ, যেমন পর্যটক, যদি ঢোকে তা হলে তাদের যে নিজস্ব ও স্বাভাবিক চালচলন, চলাফেলা, মিলন ও শৈশব ভীষণ ভাবে ব্যাহত হয়। বর্ষাকালে গাছেরা নবজন্ম লাভ করে। গাছেরা আবার এই সব প্রাণীদের আশ্রয়স্থল। গাছ যদি বাড়তে না পারে তা হলে পাখিরা সমস্যায় পড়বে, তারা উপযুক্ত বাসস্থান পাবে না।
এই সব অরণ্যে পর্যটক চলে গেলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে সেটা দেখা দরকার। পর্যটক গেলে তাদের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বনদপ্তরকে। এই সময় সারা ভারতে বর্ষাকাল, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে। বর্ষার সময় বৃষ্টির জেরে বিভিন্ন নদীতে জল বাড়ে, কোথাও কোথাও বন্যা হয়। তখন নিচু জায়গা থেকে প্রাণীরা উঁচু জায়গায় যেতে থাকে। একেবারে মাটিতে বসবাসকারী প্রাণী, যেমন সাপ, বেঙ প্রভৃতি তখন ডাঙায় উঠে আসে। তাই গাড়িতে করে এই সময় বনাঞ্চলে পর্যটক এলে এই সমস্ত সরিসৃপ ও উভচর প্রাণীরা মারা যাবে। বড় প্রাণীরা যখন এই সব নীচু জায়গা থেকে উঁচু জায়গায় উঠে আসবে, তখন বড় প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের ও গাড়ির সংঘাত বাধবে। গাড়ির ধাক্কায় বড় প্রাণী আহত হতে পারে।
বড় প্রাণীগুলোর ক্ষেত্রেও এই সময়টি প্রজননের সময়, তাই তারাও সমস্যায় পড়বে। তা ছাড়া গত দশ বছরের বিভিন্ন সমীক্ষামূলক রিপোর্টে দেখা গেছে এই সময় হাতি গণ্ডার ও হরিণ সবেচেয়ে বেশি সংখ্যায় জলে পড়ে যায়। তখন এদেরও উদ্ধার করার দরকার হয়। পর্যটকদের যদি এই সময় বনে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়, তখন বনকর্মীরা কোন দিকে নজর দেবেন, তাঁদের দিকে নাকি পর্যটকদের দিকে? তা ছাড়া পর্যটক ঢুকলে উদ্ধার করা প্রাণীদের আনা হবে কোন পথে, রাখাই বা হবে কী ভাবে? এই সময় অনেক প্রাণীর আশ্রয়স্থল হয় রাস্তাই। সেই রাস্তাতেই তো তখন জায়গা থাকবে না!
এ ক্ষেত্রে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা দরকার। কয়েক বছর আগে অসমের মানস অভয়ারণ্যে একটি সেতু ভেঙে গিয়েছিল। তখন যাঁরা কাজে গিয়েছিলেন ওই অরণ্যে, চার দিন লেগে যায় তাঁদের উদ্ধার করতে। এই সময় সেতুর ভেঙে যাওয়ার-ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই পর্যটকদের দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায়, এই সময়ে বনে যেতে হলে বিপদের ঝুঁকি থাকবে। প্রাণহাণির আশঙ্কাও থাকতে পারে।
বাস্তুরীতিও ভেঙে পড়তে পারে অরণ্যের। ছোট ছোট প্রাণীগুলো গাড়ির নীচে চাপা পড়ে যাবে। সাপ হল অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেঙও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই প্রাণীর বেশি হারে মৃত্যু হলে অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র ব্যাহত হবে। মিলনের সময়ে ব্যাঘাত ঘটলেও একই ভাবে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হবে।
বক্সা ও জয়ন্তীর উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। বর্ষায় পোখরি পুরো সাপে ভরা থাকে। আমি বনদপ্তরের পক্ষ থেকে সেখানে গেছি একাধিক বার। পরে আমরা চিন্তা করি যে ওখানে যাওয়া উচিৎই নয়।
আমাদের দেশে পর্ণমোচী গাছ না বাড়লে ও না বড় হলে অরণ্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই সব গাছ বর্ষাকালে বেড়ে ওঠে। এই সব গাছে প্রচুর সংখ্যায় পোকামাকড়-কীটপতঙ্গ আশ্রয় নেয়। আনুবীক্ষণিক জীবও থাকে এই সব গাছে। তাদেরও সমস্যা হবে। সব মিলিয়ে অরণ্যে বিপর্য়য় ঘটতে পারে। বিশ্বের কোথাও বর্ষাকালে অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। তা ছড়া আমাদের দেশে অরণ্য খুলে দেওয়ার পেরে ১৫ দিন খুব কম পর্যটককেই প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।