সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ, ভারতের প্রয়োজন একনায়কতন্ত্র

যে কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য জীবনযাত্রার মান বাড়ানো

 |  6-minute read |   17-09-2018
  • Total Shares

ভারত, নেপাল, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশুগুলোর বর্তমান শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আমি শুধুই সমালোচনা করে থাকি, কিন্তু এইসব দেশের উন্নতিসাধনের জন্যে আমি কোনও ইতিবাচক সমাধান সূত্রের কথা কোনও দিনও বলি না - আমার অনেক গুণগ্রাহী এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের সেই দুঃখ দূর করতেই আমার এই প্রতিবেদন।

মানছি, আমি একটু বেশিই সমালোচনা করে থাকি। কারণ, ভারত ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর শাসন ব্যবস্থা সত্যি সত্যিই দুর্বিসহ। আমাদের নেতাদের অধিকাংশই অসৎ। দেশের জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র এঁদের দায়বদ্ধতা নেই, এরা শুধুমাত্র ক্ষমতা ও অর্থের পিশাচ।

বুদ্ধিমত্তার বিচারে দেশের জনগণ ও দেশের সমাজ এখনও অনেকটাই পিছিয়ে এবং জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদে বিশ্বাসী। আমাদের নেতারা আমাদের এই দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নিয়ে আমাদের শোষণ করে চলেছে।

সীমাহীন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কৃষকদের বেদনা (যে কারণে ভারতের লক্ষাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন), অপুষ্টি, উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব, সংখ্যালঘু, মহিলা ও দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব ও নিপীড়ন - এ সব কিছুই আমাদের দেশে এখনও রয়েছে।

আমি বর্তমান শাসনব্যবস্থার বহুল সমালোচনা করে থাকি কারণ আমি বিশ্বাস করি যে পুরোনোকে ধ্বংস না করলে কোনও কিছুই নতুন রূপে গড়ে তোলা যায় না। দেশের জনগণ যাতে উন্নতমানের জীবনযাপন করতে পারে তার জন্য বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা প্রয়োজন।

সেক্ষেত্রে ইতিবাচক সমাধান সূত্রটা ঠিক কী?

পশ্চিমি দেশগুলোর থেকে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র মানে তো জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ভোটব্যাঙ্ককে খুশি রাখা। দেশের ভোটদাতারা ভোটদানের সময় প্রার্থীর যোগ্যতা বিচার করে না। তারা শুধুমাত্র প্রার্থীর জাত বা ধর্ম (বা প্রার্থীর দল কোন জাতের বা কোন ধর্মের লোকদের প্রতিনিধিত্ব করছে) দেখে। দেশের উন্নতিসাধনের জন্যে এই জাতপাত বা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের মতো সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ধ্বংস করতে হবে, যে শক্তি সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

body_091718024349.jpgসংসদ ভবনের সামনে উড়ছে জাতীয় পতাকা [ছবি: রয়টার্স ]

সংসদীয় গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের উপর নির্ভরশীল - কিন্তু এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারেরই তো বিচারবুদ্ধি কম। তারা কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেবে তাদের কাছে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল? তাই সংসদীয় গণতন্ত্রের উপরে আমার একেবারেই আস্থা নেই।

তা হলে, সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকল্প উপায় কী?

আমার মতে, অল্প সংখ্যক বিচারবুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন লোকের একনায়কতন্ত্র, যাঁরা কঠোর ভাবে দেশের সামন্ততান্ত্রি ব্যবস্থা ও রীতিনীতি এবং ধর্মীয় উন্মাদনা দমন করে দেশে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে ও দেশকে আধুনিক করে তুলে জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটাবেন।

যে কোনও শাসনব্যবস্থার মান একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে - সেই ব্যবস্থা কি জনগণের জীবনযাপনের মান বাড়াতে সক্ষম? সেই ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্র হোক, সেনাবাহিনীর শাসন বা সমাজতান্ত্রিক সরকার -- যাই হোক না কেন।

আসুন, বিশ্ব জুড়ে তিনটি উদাহরণের উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

তুরস্ক

একটা সময় সামন্ততন্ত্রে বিশ্বাসী সুলতানরা তুরস্ক (অটোমান সাম্রাজ্য) শাসন করতেন। তাদের শাসনকালে তুরস্ক অনগ্রসর রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত ছিল। দেশের লোকেরা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করত। তুরস্ককে তখন ইউরোপের 'সিক ম্যান' বলে সম্বোধন করা হত।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীর জেনারেল মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক দেশের রাজতন্ত্র ও খিলাফত প্রথাকে নির্মূল করে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বুঝতে পেরে ছিলেন যে তুরস্কের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে সামন্ততন্ত্র। তাই সেই প্রথা বিলুপ্ত করে তিনি দেশের আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের উপর জোর দেন। জনগণকে পশ্চিমী ধারার জীবনযাত্রা অনুসরণ করার জন্য উজ্জীবিত করেন।

body1_091718024455.jpgতুরস্কের রাজধানীতে আতাতুর্ক ছবি হাতে ছাত্রদল [ছবি: রয়টার্স]

শরিয়তি আইন ও ধর্মীয় আদালতগুলোকে বাতিল করে পশ্চিমী আইন ব্যবস্থার সূচনা করেন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে (মাদ্রাসা) বন্ধ করে দেশ জুড়ে আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। বোরখা ও ফেজ টুপি পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মহিলাদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ করে দেন। আরবি বর্ণমালার বদলে রোমান হরফ চালু করেন। কোনও রকম বিরোধিতা না মেনেই  তুরস্ককে আধুনিক করে গড়ে তুলে ছিলেন আতাতুর্ক। এর ফলে, তুরস্ক থেকে সামন্ততন্ত্র খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়।

জাপান

১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি জাপান শাসন করতেন সামন্তবাদী তোকুগাওয়া শোগান (সেনা শাসন)। তোকুগাওয়া শাসনকালে দেশের একজন করে সম্রাট থাকতেন। কিন্তু শুধুই 'নাম কা ওয়াস্তে'। এই শোগানদের (সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতা) নিচে থাকতেন 'ডাইমিয়স'-রা যাদের জমিদার বলা যেতেই পারে। এই ডাইমিয়সদের নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকত যে বাহিনীর সৈনিকদের বলা হত সামুরাই। 

১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের মেইজি শাসনের অবসানের পরে জাপান জুড়ে সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হয়। এর পরে দেশের সার্বিক উন্নতিসাধন ও শিল্পায়ন লক্ষ করা গিয়েছিল।

সেই সময় যে সব নেতারা ক্ষমতায় এলেন প্রত্যেকেই আধুনিক মানসিকতার ছিলেন। ৫০ জন শীর্ষ আধিকারিককে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হল যাতে তারা শিল্প, বাণিজ্য সেনাবাহিনী পরিচালনার মতো বিষয়গুলিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ফিরতে পারেন। তাঁরা আধুনিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরলেন। পশ্চিমী দেশগুলোর প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীদের জাপানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাপানের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্যে। হাতে কলমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার জন্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল যেখানে পশ্চিমি দেশগুলোর থেকে অধ্যাপকদের যোগদানের জন্যে আহ্বান করা হত।

body2_091718024621.jpg২০২০ সালের অলিম্পিক্স আসর বসতে চলেছে টোকিওতে [ছবি: রয়টার্স]

সরকারের তরফ থেকে রেল, সড়ক ও বন্দর, টেলিগ্রাফ ও বিদ্যুদয়নের মতো পরিষেবা দেওয়ার জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকেও জাহাজ নির্মাণের কারখানা, বয়ন কারখানা, খনি, চিনি, সিমেন্ট ও রাসায়নিক কারখানা প্রতিষ্ঠা করে হয়েছিল। পরিবর্তীকালে যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

ডাইমিয়সদের ক্ষমতা হ্রাস করা হল এবং তাদের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীও ভেঙে দেওয়া হল। তার বদলে বিশ্বের রণনীতির কথা মাথায় রেখে একটি আধুনিক জাতীয় সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হল।

একই সঙ্গে জাপান জুড়ে ছেলেমেয়েদের জন্যে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হল।

এর ফলে, দেশের সামন্ততন্ত্রের পুরোপুরি বিলোপ ঘটল ও আধুনিক জাপানের জন্ম হল। অচিরেই নতুন জাপান এতটাই শাক্তিশালী হয়ে উঠল যে ১৯০৪ সালের যুদ্ধে রাশিয়ার মতো ইউরোপীয় শক্তিকে পরাস্ত করল।

চিন

চিঙ্ক রাজবংশের অধীনে চিন অতি দরিদ্র একটি রাষ্ট্র ছিল। ১৯১১ সালে এই রাজবংশের পতনের পরে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে চিন। এই যুদ্ধের ফলেই ১৯৪৯ সালে বিদ্রোহের সূচনা হয়।

বিদ্রোহের শেষে যাঁরা ক্ষমতায় আসেন এদের প্রত্যেকেই আধুনিক মানসিকতার এবং তাঁরা বুঝতে পারেন যে চিনকে আধুনিক করে তুলতে হবে। এঁরাও কমিউনিস্ট ছিলেন কিন্তু এরা ঠিক রুশ কমিউনিস্ট নেতাদের মতো ছিলেন না। তাঁরা আদতে সামন্তবাদ বিরোধী ছিলেন এবং তাঁদের আমলেই চিন থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

body3_091718024713.jpgবুলেট ট্রেন এখন চিনের গর্ব [ছবি: রয়টার্স]

বর্তমানে, বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ চিন। সত্যি, স্বাধীনতার মাত্র ৭০ বছরের মধ্যে এক হতদরিদ্র রাষ্ট্রের এই রূপান্তর সত্যিই বিস্ময়কর।

এই তিনটে উদাহরণের মধ্যে দিয়ে আমি তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের কথা তুলে ধরেছি যে দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নয়, একনায়কতন্ত্রের দ্বারা আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়ন হয়েছে। তিনটে দেশের মধ্যে একটি ব্যাপারে মিল রয়েছে। তিনটে দেশই নির্বাচনের উপর বিশ্বাস না করে সামন্তবাদ ধ্বংস করে সফল হয়েছে।

পাশাপাশি, সেনাবাহিনীও এই কর্মকাণ্ডে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মুস্তাফা কেমাল নিজে একজন সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিলেন এবং তিনি তাঁর দেশকে আধুনিক করে তোলার জন্যে সেনাবাহিনীর আধিকারিকদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছে ইসমেত ইননু যিনি ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদে আতাতুর্কের স্থলাভিষিক্ত হন।

জাপানের মেইজি প্রত্যপর্ণের পর নতুন করে জাপানি সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। আধুনিক মনষ্ক নেতাদের হাতে তৈরি এই সেনবাহিনী অচিরেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

চিনের রেড আর্মি তৈরি করেছিলেন দেশের কমুনিস্ট নেতৃত্ব। এটি একটি নতুন ধরণের সেনবাহিনী যাদের নেতৃত্বে ছিলেন দেশের রাজনৈতিক নেতারাই।

একটা কথা বুঝতে হবে যে এই তিনটে দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই ভীষণরকম ভাবে আধুনিক মানসিকতার ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তা যদি না হত তা হলে দেশগুলো এতটা উন্নতি করে উঠতে পারত না।

তবে তার মানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা গেলেই যে রাষ্ট্রের প্রভূত উন্নতি সাধন হবে, এমনটা নয়।

এই তিনটি উদাহরণের বিশ্লেষণের পর এবার আমরা সেই প্রশ্নে ফিরে আসি যা এই প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা হয়ে ছিল। ভারত ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে কী ভাবে আধুনিক করে তোলা সম্ভব যাতে জনগণের জীবনযাপনের মান বাড়তে পারে?

এর জন্য আমাদের অনতিবিলম্বে সামন্ততন্ত্র পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা, রীতিনীতি ও আচার আচরণও বন্ধ করতে হবে। এই লক্ষে কী ভাবে পৌঁছানো সম্ভব হবে তার কোনও উত্তর সত্যি সত্যিই আমার কাছে নেই। কিন্তু তিনটে উদহারণ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে সংসদীয় গণতন্ত্র দেশের আধুনিকীকরণে বাধা সৃষ্টি করছে এবং এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তাই দেশের প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক সমাজের কাছে আমার অনুরোধ তাঁরা বিচারবুদ্ধি দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকল্প কোনও রাস্তা খুঁজে বের করুক। এমন একটি ব্যবস্থা যে ব্যবস্থায় সামন্তবাদ পাকাপাকি ভাবে বিলুপ্ত হবে এবং দেশ জুড়ে সত্যি সত্যি শিল্পায়নের জোয়ার আসবে। আধুনিক হয়ে উঠবে ভারত।

ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, এই দায় দায়িত্ব সর্বদাই দেশপ্রেমিক জনগণের উপরেই বর্তায়।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MARKANDEY KATJU MARKANDEY KATJU @mkatju

Former Judge, Supreme Court of India and former Chairman, Press Council of India

Comment