সাঁতরাগাছি ঝিলে এবছর তিনগুণ পাখি, তবুও আশঙ্কা বাড়ছে
পাঁচ বছরের হিসাবে পাখি কমছে, সমস্যা হবে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায়
- Total Shares
শীত শেষ। হাওড়ার সাঁতরাগাছি ঝিল নিয়ে যে আশঙ্কা গত বছর ছিল, সেই আশঙ্কাও শেষ। কারণ গত বছরের তুলনায় এ বছর আরও বেশি সংখ্যায়, এক কথায় মোটামুটি তিনগুণ পাখি এসেছে এখানে। যাযাবর পাখিদের এই আগমন হঠাৎ নয়, আবার গত বছর কমে গিয়েছিল সেটিও অকারণ কমে গিয়েছিল এমন নয়।
এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি, সাঁতরাগাছির ঝিলে যে সব পাখি আসে সেগুলি সাইবেরিয়া থেকে নয়, আসে মূলত আশপাশের রাজ্য ও কযেকটি দেশ থেকে।
এক বছরে পাখির সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে (ফাইল ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
প্রথমেই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ দেওয়া যাক। ২০১৪ সালে এখানে ২০টি প্রজাতির ৭৩১৭টি পাখি এসেছিল, পরের বছর এসেছিল ২০টি প্রজাতিরই ৭২৯৭টি প্রজাতির পাখি। যদিও ২০১৬ সাল থেকে পাখির সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৬ সালে ১৮টি প্রজাতির ১৮টি প্রজাতির ৫৪৭৪টি এবং পরের বছর ১৪টি প্রজাতির ৩১১৮টি পাখি এসেছিল। আশঙ্কার কথা, ২০১৮ সালে এক লাফে সংখ্যাটি কমে হয়ে গেল ৮০০! অন্য হিসাবে, মানে প্রজাতির সংখ্যা বিচার করলে ১৪টি প্রজাতির পাখি এসেছিল এখানে। এবার অবশ্য সংখ্যাটি বেড়ে ২৮৮৯ হয়েছে, মোট ১৬টি প্রজাতির পাখি এসেছিল। এই গণনা করা হয়েছে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। সম্প্রতি রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে।
পাখির সংখ্যা ধারাবাহিক ভাবে যে কমছে তার বিভিন্ন কারণ আছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হল – ২৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে স্বাভাবিক পরিবেশের পরিবর্তন ও খাদ্যের অভাব। মনে রাখতে হবে, এই সব এলাকায় পাখি শিকার করার অভিযোগ পাওয়া যায় না, বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়ে থাকতে পারে।
গত বছর পাখির সংখ্যা আচমকা কমে গিয়েছিল অবশ্য অন্য কারণে। আসলে পরিবেশ আদালতের নির্দেশ এবং তা মানতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত ভুল করে ফেলা – এই কারণেই পরিযায়ী পাখিরা আসেনি বা এলেও থাকেনি।
সাঁতরাগাছি ঝিল পরিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। পরিষ্কার করতে গিয়ে বর্জ্য পদার্থের (থার্মোকল, প্লাস্টিক প্রভৃতি পদার্থ যা পচনশীল নয়) সঙ্গে কচুরিপানাও সাফ করে ফেলে হাওড়া পুরনিগম। কচুরিপানা সাফ করে ফেললে পাখিদের বসার জায়গা যেমন থাকে না তেমনি জলও দ্রুত গরম হয়ে যায়। এর ফলে জলজ প্রাণীরাও সঙ্কটে পড়ে, তারাও বিশ্রাম করার জায়গা খুঁজে পায় না। তাদের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়ে।
শীতের অতিথিরা। (ফাইল ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
এ বার কয়েকটি সংস্থা ঝিল পরিষ্কার করলেও মাঝে কয়েকটি অংশ জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে যাকে ইংরেজিতে বলে আইল্যান্ড, বাংলায় দ্বীপ। কিছুটা কচুরিপানাও রেখে দেয়। তার ফলেই যে পাখির দল মুখ ফিরিয়েছিল, তারা আবার নতুন করে আসতে শুরু করে।
পাখিরা নতুন করে আসায় পক্ষিপ্রেমীদের পাশাপাশি এলাকার লোকজনও খুশি, কারণ এই সময় পক্ষিপ্রেমী, পক্ষিবিশারদদের পাশাপাশি মাস আড়াই ধরে শখের চিত্রগ্রাহকদের আনাগোনা থাকে, ফলে স্থানীয়দের ব্যবসা সামান্য হলেও বাড়ে।
এটি পাখিরালয় হিসাবে স্বীকৃত, ৯৮ একরের এই ঝিল ও সংলগ্ন এলাকা জাতীয় পাখিরালয় হওয়ার দাবিদারও। এখন নতুন করে সেই দাবি আবার উঠছে। জাতীয় পাখিরালয় হলে এখানে নতুন করে জমি দখল করে দোকান-আবাস গড়ে ওঠা কমবে বলেই লোকের ধারনা। সাঁতরাগাছি স্টেশন সংলগ্ন এই এলাকা তীব্র শব্দ ও রাতে তীব্র আলোর হাত থেকে রেহাই পাবে না, পাওয়া সম্ভবও নয়। কিন্তু জাতীয় পাখিরালয়ের মর্যাদা পেলে সমস্যা অন্তত বাড়বে না বলেই ধারনা। তা ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণও হবে অনেক ভালো ভাবে, পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হলে লোকের নজরও থাকবে। যদিও বেশি সংখ্যায় পর্যটক এলে ও গোলমাল হলে পাখিরা আসা বন্ধ করে দিতে পারে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়।
প্রশ্ন হল, শুধুমাত্র লোকের মনোরঞ্জনের জন্য আর পক্ষিপ্রেমীদের জন্যই এই জায়গাকে এত গুরুত্ব দিতে হবে? একেবারেই নয়। স্মরণাতীত কাল ধরে এখানে পরিযায়ী পাখি আসে এবং সেই কারণেই বাস্তুতন্ত্র বা ইকো সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এই সব পাখি। অবৈজ্ঞানিক ভাবে ঝিল পরিষ্কার করলে যেমন প্ল্যাঙ্কটনের ক্ষতি হয়, তেমনি বর্জ্য পদার্থের কারণেও তাদের ক্ষতি হয়। সেই কারণেই এখানে পাখি আসা জরুরি। তাই এলাকার লোকজন চান না নতুন করে জবরদখল হোক এই এলাকা, ধ্বংস হোক বিশাল প্রকৃতির বুকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই জলাশয়।
ঝিল বাঁচাতে নতুন করে আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছেন পরিবেশপ্রেমীরা। তাঁরা চান, ঝিলে ময়লা ফেললে যেন জরিমানা করা হয়। এ জন্য নজরদারি ক্যামেরা বসানোই প্রাথমিক উপায় বলে তাঁরা মনে করছেন।
পাঁচ বছরের হিসাবে কমেছে পাখির সংখ্যা। (ফাইল ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
এলাকাটি সাইলেন্ট জোন বলে ঘোষণা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পাশেই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ও কারশেড থাকায় শব্দ অনিবার্য। তাই স্টেশনের মাইকের মুখ ঝিলের দিকে না রাখা ও এখানে হর্ন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার ব্যাপারে দক্ষিণপূর্ব রেলের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। শান্টিং-এর সময় শব্দ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার অনুরোধও করেছেন। নীতিগত ভাবে তাঁদের অনুরোধে সায় দিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। যদিও এখনও তা কার্যকর হয়নি।
ঝিলের পাড়ে গজিয়ে ওঠা দোকানগুলিতে এখনও কাঠ, কাঠকয়লা, কয়লা ও কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। সেগুলি পরিবেশের ক্ষতি করে। তা ছাড়া ঝিলের জলের উপরেও দোকান তৈরি হয়েছে। এই সব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে কাজের কাজ হবে বলে মনে হয় না।
বিস্তীর্ণ এলাকার নিকাশি জল এই ঝিলেই জমা হয়, নিকাশি নালার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া সহজ নয়, দাবি করলেই তা পূরণ করা যায় না, কারণ খরচ বহু কোটি টাকা। পুর নিগমের পক্ষে তা করা কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই অবস্থায় এটি জাতীয় সরোবর তকমা পেলে সুরাহা হতে পারে।