এনআরসির কালো মেঘ কুমোরটুলিতে ছায়া ফেললে কী হবে, ভাবতেই শিহরণ জাগে
অস্থির ভোটব্যাঙ্কের হিসেব-নিকেশের সময় কোনও প্রতিশ্রুতিরই কানাকড়িও দাম নেই
- Total Shares
একদিকে আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা পুণ্যতোয়া গঙ্গা। অন্যদিকে, সুপ্রাচীন জনপদ চিৎপুর। কলকাতা পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রাচীন জনপদ দেশবিদেশে পর্যটকদের আকর্ষণ স্থল। উৎসব-পার্বনে যে সমস্ত ট্যুর অপারেটর পর্যটকদের কলকাতা ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করেন, তাঁদের মানচিত্রে এই জনভূমির অস্তিত্ব জ্বলজ্বল করে। এখানে বাস করেন দেবতা গড়ার কারিগররা। এর নাম কুমোরটুলি।
পলাশীর যুদ্ধের আগেও এখানে থাকতেন মাটির হাঁড়িকুড়ি তৈরির কারিগররা। সেই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তাদের নির্দেশে হলওয়েল সাহেব কোম্পানির নিযুক্ত কারিগরদের জন্য নির্দিষ্ট বাসস্থান এলাকা চিহ্নিত করে ছিলেন। এই কারণে শহর হিসেবে কলকাতার গড়ে ওঠার শৈশবে তৈরি হয়েছিল শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতোরপাড়া, আহিরীটোলা ও কুমোরটুলি। জনশ্রুতি বলে, কুমোরটুলি নামটা এসেছে কুমোরদের বাসস্থান হিসেবে।
লোকমুখে শোনা যায় পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের বন্ধু হয়ে ওঠা শোভাবাজারের বাসিন্দা কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ধুমধাম করে ইংরেজদের পলাশী যুদ্ধ জয়ের উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, রাজা নবকৃষ্ণ দেব জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো শুরু করেন সেই ১৭৫৭ সালে। সেই সময় তিনি কৃষ্ণনগর থেকে মূর্তি গড়ার কারিগরদের এনেছিলেন কুমোরটুলিতে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরে বাবু কলকাতার অনেক অর্থবান পরিবারেই দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল ধুমধাম করে। সেই সময় থেকেই গড়ে ওঠে আজকের কুমোরটুলি।
বিংশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় জন্ম নিয়েছিল বারোয়ারি পুজো। ফলে, জমে ওঠে কুমোরটুলির কারিগরদের ব্যবসা। কলকাতার কথাকাররা জানাচ্ছেন ওই সময়তেই ঠাকুর গড়ার সনাতন প্রথাতেও আসে পরিবর্তন। এক চালা ঠাকুর গড়ার রেওয়াজ ভেঙে অন্য ফর্মে ঠাকুর গড়তে শুরু করে ছিলেন কুমোরটুলির শিল্পীরা।
কুমোরটুলির অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বিবর্তনের ইতিহাস। একটু একটু করে এই বিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে কুমোরটুলির জনবিন্যাস। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ কলকাতার ভূগোল ও জনবিন্যাসকে অনেকটাই ওলটপালট করে দিয়েছে। এই ভাঙাগড়ার ইতিহাসও কুমোরটুলির সর্পিল অলি-গলিতে লুকিয়ে রয়েছে।
কুমোরটুলির অলি-গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বিবর্তনের ইতিহাস [ছবি:পিটিআই]
দেশভাগের সেই অশান্ত সময়ে ওপার বাংলা থেকে এক দল মূর্তি শিল্পী ছিন্নমূল হয়ে ভেসে এসে ছিলেন কুমোরটুলিতে। ওপার বাংলা থেকে আদি জনস্রোতের প্রতিনিধি ছিলেন মূর্তি শিল্পী রমেশচন্দ্র পাল। তাঁর হাত ধরেই মূর্তি শিল্পীদের সংস্থা শিল্পী কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। কলকাতা শহরের তখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি কোথাও। গ্যাস লাইটের আলোতেই একটু একটু করে গড়ে উঠত দেবীর অবয়ব। সেই সময় শিল্পীদের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য তৈরি হয়েছিল শিল্পীকেন্দ্র সংগঠন।
গঙ্গা দিয়ে তারপরে অনেক স্রোত বয়ে গিয়েছে। তেমনই কুমোরটুলিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। যদিও আজও সাবেক প্রথা মেনে গঙ্গায় স্নান করে শুচিবস্ত্র পরে শিল্পীরা প্রতিমার চক্ষুদান করেন বৈদ্যুতিক আলোয়।
দেশভাগের সময়েই ঢাকার বিক্রমপুর থেকে ভাইবোন-সহ সপরিবারে কুমোরটুলিতে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে ছিলেন রাখালচন্দ্র রুদ্র পাল। ভিটে মাটি হারানো এই পরিবারগুলিকে কুমোরটুলিতে জায়গা করে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়ে ছিল। সবাই যে তখন কুমোরটুলির মূল এলাকায় স্থান পেয়েছিলেন তা নয়। তাঁরা কুমোরটুলির আশপাশেই জায়গা গড়ে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই কুমোরটুলিতে আজও তার চিহ্ন বহন করেছে বাঙাল পট্টি-ঘটি পট্টি।
ময়দানে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হলে তার উত্তাপ কিছুটা এই দুই পট্টিতে ছড়ানোর বাইরে অন্য কোনও বিভেদ নেই। দুই বাংলার লোকায়ত ধর্মের পুজোপাঠে যে বৈচিত্র্য রয়েছে তাও খুঁজে পাওয়া যাবে এই কুমোরটুলিতে। প্রতিমার বায়নাদারদের থেকে শিল্পীরা আদায় করেন যে চাঁদা তার নাম ঈশ্বর-বিক্রি। তার সঙ্গে যোগ হয় নিজেদের এলাকার চাঁদা। সেই অর্থে দোলপূর্ণিমার সময় বিশেষ পুজোয় মেতে ওঠে কুমোরটুলি। ঘটি-বাঙালের নিজস্ব ছন্দে কালী-শীতলা পুজোর মন্ত্রে ভেসে যায় কুমোরটুলি।
এখানে এপার-ওপার মুছে গিয়ে দেবকর্মাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে [ছবি: অর্পণ গঙ্গোপাধ্যায়]
বাঙাল পট্টিতে এই পুজোর সঙ্গে সংযোজন হল বাসন্তী পুজো। যদিও কোনও পুজোতেই মেলামেশা বা মেতে ওঠায় ভেদরেখা নেই এই জনপদে। কুটিল সময়ের সঙ্গে হাজারও সমস্যা দেখা দিলেও মিলনের মধ্যেই বসবাসে এখানকার বাসিন্দাদের আনন্দ।
ভারতের আকাশে এখন হঠাৎই কালো মেঘ ছড়িয়েছে - এনআরসি। অসমে খোঁজ চলছে কারা বিদেশি ও কারা ভারতীয়। সেখানকার বিষ বাতাসে ঘুরছে ফিরছে বাংলাদেশী শব্দটি। ওপার বাংলা থেকে কারা কখন এপারে পা বাড়িয়েছে তার হিসেবে নিকেশ চলছে। যদিও দেশভাগের সময় দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সাবেক পূর্বপাকিস্তানের অসহায় মানুষদের বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল স্বাধীন ভারত তাদের বিস্মৃত হবে না। প্রয়োজনে সব সময় তাদের জন্য দরজা খোলা থাকবে।
সেই কথা মনে রাখলে ১৯৭১ সালের পরেও ওপার বাংলা থেকে যাঁরা এপারে এসেছেন তাঁদেরও ছুড়ে ফেলা যায় না। কিন্তু এই অস্থির ভোটব্যাঙ্কের হিসেবে-নিকেশের সময় এই প্রতিশ্রুতির কানাকড়িও দাম নেই। ভাবতেই শিহরণ জাগে এনআরসির কালো মেঘ যদি কুমোরটুলিতে ছায়া ফেলে তাহলে কী হবে। এখানে তো এপার ওপার মুছে গিয়ে দেবকর্মাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যার পরতে পরতে ইট গেঁথেছে সহবাসের ধর্ম। সেই পরিচয় নিয়েই তো দেশ বিদেশের পর্যটকদের সামনে দুয়ার খুলে দাঁড়ায় কুমোরটুলি।
কালের স্রোতে ভেসে আসা বিবর্তন ও বিপদ-আপদকে চোখে চোখ রেখে বুঝে নিয়ে প্রতিমা গড়ার পাশাপাশি জীবনযাপনও গড়ে তোলে কুমোরটুলি। এখানেও কি কেউ কোনও দিন হাঁক পাড়বে বাপ পিতামহের জীবনপঞ্জি দেখাও। এদের তো বংশ পরম্পরায় সাকিন দেবদেবীদের কাঠামোয়।