২০০৬তে বুদ্ধদেব সরকার শিল্পায়নের রাস্তায় হাঁটা শুরু করে, মূল দায়িত্বে ছিলেন নিরুপম সেন

শুধুমাত্র আমলাদের নিয়ে অভিমুখ বদলের কাজ ভুল ছিল, তিনি বুঝেছিলেন কিনা জানিনা

 |  3-minute read |   26-12-2018
  • Total Shares

২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজভবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ছবিতেই বার্তাটা স্পষ্ট ছিল। সেই প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে রাজ্যের ও ভিনরাজ্যে প্রথম সারির শিল্পপতিরা উপস্থিত ছিলেন।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের একদিন পরে সব সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়েছিল। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের সদর দপ্তরে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন রাজ্যের প্রথম সারির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পদপ্তর সিপিএম শরিক দল ফরওয়ার্ড ব্লককে ছেড়ে দিয়েছিল। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকারের বড় শরিক সিপিএমের কাছে শিল্পদপ্তর ছিল দুয়োরানীর সমান। সুয়োরানীর মর্যাদা ছিল ভূমি ও ভূমিরাজস্ব দপ্তর ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের।

তবে নয়ের দশকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদার অর্থনীতিতে লাইসেন্স প্রথা উঠে গেলে তার সুযোগ নেওয়ার কথা বলে সিপিএম। ১৯৯৪ সালে জ্যোতি বসু সরকার এই কেন্দ্রীয় নীতির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যের নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করেন। সেই সময়ে সিপিএম বলেছিল, 'শিল্পায়ন নীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগকে রাজ্যে আনার উদ্যোগ নিতে হবে'।

body_122618045609.jpg বামফ্রন্ট সরকারে প্রথম সিপিএমের শিল্প মন্ত্রী হয়েছিলেন নিরুপম সেন [ছবি: পিটিআই]

সেই শিল্পনীতি নিয়ে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখানে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল তাতে বলা হয় শিল্পে বিনিয়োন্ত্রনও বিলাইসেনসিংয়ের পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে পুঁজি আকর্ষণের জন্য বামফ্রন্ট সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে, জ্যোতি বসুর সরকার বেসরকারি বিনিয়োগের পথে এগোতে চাইলেও সরকারের অভিমুখ আমূল বদলাতে পারেনি।

অচলায়তনের এই ছবিটা বদলে যায় ২০০৬ সালে।

রাজ্যে ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসন পেয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও নিরুপম সেনরা দলের কৃষক সভা ও সিটুকেও বেসরকারি পুঁজির আরাধনায় রাজি করতে পারেন।

২০০৬ সালে সরকার গঠনের পরে সিপিএমের পাক্ষিক পত্রিকা 'মার্ক্সবাদীর পথে' সাখ্যাৎকারে নিরুপম শিল্প ও জমি অধিগ্রহণে চিন ও ভিয়েতনামের কমুনিস্ট সরকারের উদাহরণ টেনেছিলেন। বলেছিলেন, "যারা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য উদ্যোগ না নেওয়ার কথা বলছেন তারা আজকের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।"

২০০৬ সালেই বামফ্রন্ট সরকার অভিমুখ বদলে শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহনের রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার আন্দোলন থেকে বেসরকারি শিল্পের জন্য কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ নীতি এক বড় উলম্ফন।

সরকারের নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হলেও এর মূল দায়িত্ব ছিল নিরুপম সেনের কাছে। এই নীতির প্রদ্বীপে তেল ঢালার কাজটা নিরুপম অবশ্য শুরু করেছিলেন ২০০১ সালে। শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ, রুগ্ন সংস্থার পুনরুজ্জীবন ও অলাভজনক সংস্থা গুটিয়ে ফেলতে ব্রিটেনের ডিএফআইডি থেকে অর্থ নেওয়া - এ সবই নিরুপম শুরু করেছিলেন ২০০১ সালে প্রথমবার শিল্প মন্ত্রী হয়ে।

স্পেশাল ইকোনমিক জোন সম্পর্কে সিপিএমের অনীহা ছিল। নিরুপমবাবুই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিকে এসিজে সম্পর্কে রাকি করিয়ে ছিলেন। ২০০৩ সালে বামফ্রন্ট সরকার এসিজে আইন পাস করায় বিধানসভায়। পরে, শরিকদের চাপে এসিজে নিয়ে বেশি দূর এগোয়নি বুদ্ধদেবের সরকার।

এই পথ অবশ্য শেষ হয়েছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম বিতর্কে এসে। তবে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আবহে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে বুদ্ধদেব সরকারের প্রায় সব দপ্তরই যখন হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিল তখন নিরুপম বাবুই ছিলেন ব্যতিক্রম। সেই সময়ও রাজ্যের শিল্প দপ্তর প্রায় পাঁচ ছ'হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। পানাগড়, অন্ডাল ও খড়্গপুরে একাধিক শিল্প পার্ক গড়ে উঠেছিল।

সেই সময়ও রাজ্যের লগ্নি করেছিল টাটা হিতাচি, ম্যাটিক্স ও ট্র্যাক্টর ইন্ডিয়া। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরুপম সেন বুঝেছিলেন বর্ধমান হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরের উর্বর কৃষিজমিতে হাত দেওয়া ভুল হয়েছে। বুঝেছিলেন, কৃষককে জমির বদলে শুধুই মূল্য ধরে দিলে হবে না। তার ভবিষ্যৎ আয়েও সুনিশ্চিত করতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই নিরুপমবাবু নতুন ক্ষতিপূরণ নীতিও তৈরি করিয়ে ছিলেন।

ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার গুন নিরুপমবাবুর যে ছিল সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে দলের সংগঠনকে অন্ধকারে রেখে শুধুমাত্র আমলাদের নিয়ে এত বড় অভিমুখ বদলের রাস্তায় হাঁটা যে ভুল হয়েছিল তা তিনি বুঝে ছিলেন কিনা জানিনা। এখানেই পূর্বসূরি জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর তফাৎ।

রাজ্যের শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ যারা ছিলেন সিপিএমের ভিত তাদের বুঝিয়েই যে এগোতে হবে এই উপলব্ধিটা পড়ে হয়েছিল প্রয়াত নিরুপম সেনের।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BISWAJIT BHATTACHARYA BISWAJIT BHATTACHARYA

Veteran journalist. Left critic. Political commentator.

Comment