বলিউডের কোনও তারকার সামান্যতম শারীরিক বদল হলেই লোকে হামলে পড়ে
অন্তঃস্বত্ত্বা মডেল-অভিনেত্রী নেহা ধুপিয়ার ওজন বেড়েছে, তা নিয়ে কদর্য মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায়
- Total Shares
অন্তঃস্বত্ত্বা থাকার সময় ওজন বেড়ে যাওয়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মোটেই বিরলতম ঘটনা নয়। মাতৃত্বের সময় কোনও মহিলার ওজন বেড়ে গেলে বা সেই সময় কাকে কেমন দেখতে লাগছে তা নিয়ে মোটেই বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করা উচিত নয়।
কয়েকদিন আগে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন নেহা ধুপিয়া, এক সময় মডেল ছিলেন, পরে অভিনেত্রী হন এবং বর্তমানে তিনি এক কন্যাসন্তানের গর্বিত জননী।
একটি পোর্টালে অত্যন্ত জঘন্য শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, যেটিকে বীভৎসও বলা চলে, “গর্ভাবস্থার পরে নেহা ধুপিয়ার ওজন ভয়ানক বেড়ে গেছে...।” যে সাংবাদিক এই ধরনের একটি শিরোনাম করেছেন তাঁকে কঠোর ভাবে ধিক্কার জানানো উচিত।
প্রথমত শস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা, দ্বিতীয়ত দুর্বল ব্যাকরণ।
যাঁরা দিনরাত সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকেন এবং কার কোথায় কী ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটল তা দেখে যাঁরা আনন্দ পান তাঁরা ছাড়া আর কারও এই খবরে আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না, কিন্তু ওই অভিনেত্রীর খবর ছড়িয়ে পড়ল। আগে যেটা অবসর বিনোদন ছিল, এখন সেটাই সর্বক্ষণের নেশা হয়ে গেছে। নেহা ধুপিয়া বিরাট বড় মাপের কোনও তারকা নন যে পাপারাৎজিরা বিরল এক্সক্লুসিভ ও দুর্দান্ত কোনও ছবি পাওয়ার জন্য তাঁর পিছনে পড়ে থাকবেন। তিনি এমন একজন অভিনেত্রী, নামী ফ্যাশন শোয়ের ক্যাটওয়াকে হাঁটার অভিজ্ঞতা যাঁর রয়েছে। তাই তাঁর ওজন বেড়ে যাওয়ার খবরটি ওই বিশেষ পোর্টালে বেশি সংখ্যক পাঠককে টেনে আনবে – তাঁদের আন্দাজ যে ভুল ছিল না তা বোঝা যায় উন্মাদের মতো প্রতিক্রিয়া দেখলে।
মাতৃত্বকালে তাঁর ওজন বেড়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ায় খুব বিশ্রী পরিস্থিতির মুখে পড়েন নেহা ধুপিয়া। (ছবি: ইনস্টাগ্রাম)
মাতৃত্বের জন্য কোনও মহিলা তারকার এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মুখে পড়া এই প্রথম নয়। যাঁর মোহময়ী রূপের জন্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে ভক্তের দল, মাতৃত্বকালে সেই ঐশ্বর্য রাই বচ্চনের ওজন অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া নিয়ে আচমকাই তাঁর দিকে সকলের নজর ঘুরে গিয়েছিল। প্রতিভার পাশাপাশি রূপের জন্যও যিনি ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় ছিলেন, সেই টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাকেও এই সময়ে ছাড় দেওয়া হয়নি।
তার পরে একটা কথা না বলে পারা যাচ্ছে না যে, কৃতী ক্রিড়াবিদ হয়ে ওঠার সঙ্গে সানিয়া মির্জার রূপের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বাণিজ্যিক ছবির গতানুগতিক তারকা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই যুক্তি খাটে না, তাঁদের চমক থাকা আবশ্যিক, তাঁদেউর রূপ ও ছবির পর্দায় কী ভাবে ফুটে উঠছেন তার উপরেই নির্ভর করে সিনেমা ও সিনেমা হলে তাঁদের দর্শক টানার ক্ষমতা।
এর গুরুত্ব কোথায়?
বাণিজ্যিক হিন্দি ছবি যাঁরা চেটেপুটে খান, বিশাল পর্দায় তাঁরা ‘সুন্দর মানুষজন’কে দেখতে পছন্দ করেন।
সোজা কথায়, বর্তমান যুগে সাধারণত তাঁরাই তারকা হন যাঁদের শারীরিক উপস্থিতিটুকু দেখেই লোকে মজে যান, তাঁর অভিনয়ক্ষমতা কোনও গুরুত্বই পায় না।
বাণিজ্যিক ছবি দেখা মানে অবাস্তব সব ব্যাপার দেখা। তাই এই সব ছবির যাঁরা তারকা হবেন তাঁরা আর পাঁচজনের মতো সাধারণ হবেন, তাঁদের ব্যক্তিত্বও সাদামাটা হবে এবং পাড়ার লোকজন বা কর্মক্ষেত্রে যাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় তাঁদের মতো হবেন সেটা হতে পারে না।
যদি সত্যিই সেই তারকাকে বাস্তবে সামনে পাওয়ার ভাগ্য তাঁর কোনও ভক্তের হয়, তখন তাঁকে এমন ভাবে আসতে হবে যেন মনে হয় যে তিনি একেবারে ছবির পর্দা থেকে সরাসরি এসে হাজির হয়েছেন, অভাবনীয় ক্যারিশ্মা এবং যথোপযুক্ত চমকও আবেদন নিয়ে, যাতে তাঁর সম্পর্কে ধারনা অটুট থাকে।
অফুরান চমক: বড় পর্দায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জিমে যাওয়ার দরকার হত না দেব আনন্দের। (ছবি: ডেইলিও)
বড় পর্দায় নিজেদের মেলে ধরার জন্য দেব আনন্দ ও মধুবালাদের জিমে যাওয়ার দরকার হত না – তাঁদের চমক ও আবেদন ছিল একেবারে জন্মগত। 'দেব সাহেবে'র শরীরী ভাষাটাই ছিল প্রাণবন্ত, সর্বজয়ী হাসি আর কথা বলার অনন্য ভঙ্গিমা। মধুবালার চোখ ছিল দারুণ সুন্দর, তাঁর আকর্ষণের মূলে ছিল মধুর হাসি ও সিক্ত মুখভঙ্গিমা।
যাই হোক সময় বদলেছে। সেই সঙ্গে সাধারণ ভাবে বাণিজ্যিক ছবির চরিত্র নিয়ে দর্শকদের চাহিদাও বদলেছে।
আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় শারীরিক খুঁটিনাটি ধরা পড়ছে ক্যামেরায়। তাই অত্যন্ত সাদামাঠা অভিনেতা হয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে কাটিয়ে শারীরিক গঠন প্রায় নিখুঁত করে ফেলে টাইগার স্রফও তারকা হয়ে উঠেছেন। টাইগার স্রফের চেয়ে অনেক বেশি বড় তারকা করিনা কাপুর, তিনি সাইজ জিরো হয়েছিলেন এবং তাঁর ভক্তকুল সেটি দারুণ ভাবে গ্রহণ করেছিল – সেই সম তিনি অকল্পনীয় কৃশ হয়ে গিয়েছিলেন।
ধুপিয়ার ওজন বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি যে ঠিক নয়, সেটিকে নিয়ে যে খবর করা যায় এবং সেই খবরটি যে আলোড়ন ফেলতে পারবে সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন সেই সাংবাদিক। এই ধরনের খবর সব সময়ই আলোড়ন ফেলে।
নেহা ধুপিয়ার ওজন বেড়ে যাওয়ার খবর পাঠকের সংখ্যা বাড়িয়েছে। (ছবি: ইনস্টাগ্রাম)
সম্প্রতি নেহা ধুপিয়ার মোটাসোটা ছবি দেখা গেছে, পর্দায় ও ছবিতে যাঁর ছিমছাম চেহারা দেখে দর্শকরা অভ্যস্থ তাঁর এমন রূপ দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গেছেন। ঘটনা হল অনেক পরে তাঁর মা হওয়ার ব্যাপারটা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন।
যাঁরা কোনও কম্মে লাগেন না তাঁর সেই সব ভক্তকূলের মধ্যে এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে আর যাঁরা সবকিছুই বিশ্বাস করেন, তাঁরা তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ভারাক্রান্ত করেছেন এই ভুলভাল খবরে। এখন তাঁরা তাঁদের কিবোর্ড দাবিয়ে চলেছেন এ নিয়ে কদর্য মন্তব্য করার জন্য।
ইতিহাসকে যেন আবর্তিত হতেই হবে বিশেষ করে যখন মহিলা তারকারা তাঁদের মাতৃত্বকালীন অভিজ্ঞতা বা এই ধরনের অন্য অভিজ্ঞতার কথা বলেন। গণমাধ্যমের একাংশ, যারা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকে, যাঁদের কাছে আনন্দের অর্থ হল উদ্ভট কিছু একটা, যারা এই ধরনের খবর ছড়াতে সিদ্ধহস্ত তারা এই সব খবরের পিছনে ছুটে বেড়ায়, ভাবে কখন এমন একটা খবর আসবে।
কোনও সুস্থ-স্বাভাবিক দুনিয়ায় কোনও সাংবাদিকই কারও মাতৃত্বকালীন ওজনবৃদ্ধিকে দুভার্গ্যজনক বলে বর্ণনা করবে না – আমরা বাস্তবে যে জগতে বাস করি সেখানে তাঁদের ওয়েবসাইটে হিট বাড়ানোর জন্য তাঁদের রুচির মাত্রাটা নামিয়ে আনতে পারেন। সত্যি যদি এই খবরটির মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো কেউ কিছু খুঁজে না পান তখনই এই খবরটি আর খবর থাকবে না।
তবে ঘটনা সেটা নয়।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে