মাঝে আর মাত্র ছ'দিন, অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন অসমের বাঙালিরা
'অসম এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছে ...যেন ১৯৪৭... দেশভাগের সময়’
- Total Shares
জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নবায়ন বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) আপডেট রিপোর্ট প্রকাশিত হতে মাঝে আর মাত্র ছ'দিন। আগামী ৩১ জুলাই রিপোর্ট প্রকাশিত হবে। অসমে বিদেশি নাগরিক ও অনুপ্রবেশ বিতর্কের সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে এনআরসি রিপোর্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে, এমনই বলা হয়েছিল। ১৯৫১ সালের এনআরসি ফের ২০১৫ সাল থেকে আপডেট করার কেন প্রয়োজন হল?
তার পিছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী অসম আন্দোলন। যার অন্যতম একটি দাবি ছিল অসম থেকে বিদেশিদের বিতাড়িত করতে হবে। এই বিদেশি বলতে বোঝানো হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে 'বাংলাদেশি' জনসমষ্টিকে। ২০০৫ সালে কেন্দ্রের মনমোহন সিং সরকার এবং রাজ্যের তরুণ গগৈ সরকারের সঙ্গে আসুর ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়।
১৯৮৫ সালে আসু, অসম সরকার ও রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম অসম চুক্তি কার্যকরা করার জন্য ফের আরও এক চুক্তি সম্পাদন করে। যার মূল কথাই ছিল বিদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত ও বিতাড়িত করা। স্থির হয় ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পরে যারা ভারতে এসেছে তাদের বিদেশি বলে গণ্য করা হবে। মনে রাখতে হবে এই সময়রেখা শুধুমাত্র অসমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভারতের ক্ষেত্রে যার সীমারেখা ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। বিদেশি চিহ্নিতকরণের নানা প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও, এনআরসি প্রক্রিয়া সে ভাবে চালু করেনি পূর্ববর্তী সরকারগুলি। ২০১৪ সালে অসমের কয়েকজন নাগরিক সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন, অসম চুক্তির প্রধান ধারা -- বিদেশি শনাক্তকরণ, আটক এবং ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া -- বলবৎ করা হোক। বিচারক রোহিন্টন ফলি নরিম্যান ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের ডিভিশন বেঞ্চ শনাক্তকরণের জন্য এনআরসি নবীকরণের নির্দেশ দেন।
আতঙ্কে দিন কাটছে অসমের বাঙালিদের
তাঁরা এও জানিয়ে দেন পুরো প্রক্রিয়াটি আদালতের তত্ত্বাবধানে হবে। রাজ্যে বিজেপি-আসু সরকার প্রতিষ্ঠার পরই অতি দ্রুততার সঙ্গে এই কাজ শুরু হয় এবং অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর এনআরসি'র প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। দেখা যায়, ৩.২৯ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে ১.৯ কোটি আবেদনকারীকে 'ভারতীয় নাগরিক' হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছিল প্রাথমিক রিপোর্ট। পুনঃআবেদনের ভিত্তিতে তা ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে একপ্রস্থ যাচাই ও সংশোধন হয়েছে বলে জানিয়েছে এনআরসি কর্তৃপক্ষ।
৩১ জুলাই এনআরসি রিপোর্ট প্রকাশিত হবে
তার পরেও দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আসম ইউনিভার্সিটি'র প্রাক্তন উপাচার্য এবং বরাক উপত্যকার বাসিন্দা তপোধীর ভট্টাচার্যের নাম সে তালিকায় নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে একজন 'বিদেশি' দেশের এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করলেন কী ভাবে? উল্লেখ্য, প্রাক্তন এই উপাচার্যের পিতা ছিলেন বরাক উপত্যকার একজন কংগ্রেসি বিধায়ক। সারা অসম জুড়েই এমন অভিযোগ ভুরি ভুরি। বিশেষ করে বাঙালি প্রধান বরাকের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এবং নাম্নী অসমের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অভিযোগ তুলেছেন অন্যায় ভাবে তাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি নাগরিক অধিকার সংগঠন 'ইউনাইটেড এগেইনস্ট হেট'-এর একটি তদন্তকারী দল এই জাতীয় অভিযোগের সত্যাসত্য বিচারের জন্য অসম সফর করে। তদন্তকারী দলের নেতা, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রাক্তন আইজি এসআর দরাপুরির মন্তব্য থেকে বোঝা যায় অসম ঠিক এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। 'ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট অন অসম, ডাউটফুল সিটিজেনশিপ, ডিসটর্টেড রাইটস' শীর্ষক রিপোর্টের মুখবন্ধে দরাপুরি বলেন, 'অসম এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছে। যে কোনও সময় অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে। বিশিষ্ট নাট্যকার ও পরিচালক এবং বরাকের ভূমিপুত্র তীর্থঙ্কর চন্দ সম্প্রতি অসমে গিয়েছিলেন। তাঁর উপলব্ধিও প্রায় একই। তিনি জানিয়েছেন, "সন্ধে হলেই বরাকের পাড়ায় পাড়ায় জটলা। মানুষ ফিসফিস করে আলোচনা করছে। তার পর চুপ মেরে যাচ্ছে। যেন সাতচল্লিশ... দেশভাগের সময়...।" তদন্ত রিপোর্টেও একই প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, 'নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, মানসিক আঘাত' অসমকে এখন 'চুপিসাড়ে অনুসরণ' করে চলেছে। রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক বুনোটে 'বিশাল চিড়' ধরার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা।
আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছে অসম
এনআরসি'র বিশাল কর্মযজ্ঞকে সামাল দিতে প্রতি জেলায় খোলা হয়েছে সেবাকেন্দ্র। রাজ্য জুড়ে মোট সেবা কেন্দ্রের সংখ্যা মোট আড়াই হাজার। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বহুবিধ নথির প্রয়োজন পড়ছে। দেখা যাচ্ছে সব ধরনের নথি সবার কাছে নেই। তার অন্যতম কারণ নিম্ন থেকে উজান অসমে একের পর এক জাতি দাঙ্গা, ভয়াবহ বন্যা, উচ্ছেদ, বিয়ের পর এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে যাওয়া জাতীয় বহু কারণ। এমনও অভিযোগ উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পঞ্চায়েত গ্রামের বৈধ বসবাসকারীকে শংসাপত্র দিলেও তা গ্রাহ্য করছে না এনআরসি'র কর্মী-আধিকারিকরা। সময় মতো নোটিস না-পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। নোটিশ পাঠানো হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অথচ বিপুল সংখ্যক গ্রামে হয় ইন্টারনেট নেই, না হয় তা খুবই দুর্বল। বহু মানুষই এই প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন না। ফলত সময় মতো নোটিসের জবাব দিতে না-পারলে একতরফা ভাবে নাম ছেঁটে ফেলা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত অসমে এনআরসি'র স্টেট কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা জানিয়েছেন, ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে আবেদন করা যাবে। পুরো পদ্ধতিটি নিরপেক্ষ ও নিশ্ছিদ্র হবে। এ আশ্বাসে আদৌ নিশ্চিত নয় ভুক্তভোগী মানুষ। 'বঙ্গাল খেদা' আন্দোলন কিংবা নেলি, বরপেটা, কোকরাঝাড়ের দাঙ্গার ভূত তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।