দুর্নীতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ধারণা আমার-আপনার চেয়ে আলাদা

তাঁর কাছে আর্থিক লেনদেন দুর্নীতি নয়, আদর্শগত বিচ্যুতিই দুর্নীতির নামান্তর

 |  6-minute read |   13-02-2019
  • Total Shares

জনসমক্ষে তিনি যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

জনসমক্ষে তিনি যে অনর্গল ভাবে মিথ্যা বলে চলেছেন তা দেখেশুনে ক্রমেই আমার বিভ্রান্তি বেড়ে চলেছে। যখন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের ফল সরু সুতোর উপর ঝুলছিল তখন আচমকাই তিনি আবিষ্কার করলেন যে আহমেদ প্যাটেলকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর করার ব্যাপারে পকিস্তান চক্রান্ত করছে।

ভোটের ফল বার হতে সকলেই সেই মারাত্মক অভিযোগের কথাটি ভুলে গেলেন।

patel-1_021319040456.jpg বিজেপি কটাক্ষ করেছিল যে কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেলকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী করার ব্যাপারে পাকিস্তান কলকাঠি নাড়ছে (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাদের একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তখন লোকে আশা করেছিলেন যে, যাঁরা দুর্নীতি করেছেন তাঁদের সকলকে গ্রেফতার করা হবে এবং দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ করার শাস্তি তাঁরা পাবেন – কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচন আসতে চলল, এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি। আরও একটা কথা, দুর্নীতির অভিযোগ বিদ্ধ করেছে বিরোধী নেতানেত্রীদের যার দরুণ রাজনৈতিক সন্দেহের কুৎসিত বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সরকারের অধীন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত তদন্তকারী সংস্থা বলে যে সংস্থা পরিচিত তাঁরা যে নির্দেশ মেনে চলছে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

জনতার কাছে সত্যতা ও স্বচ্ছতার দায়বদ্ধতার কথা ব্যতিরেকেই বিপক্ষকে আক্রমণ করার অস্ত্র হিসাবে দুর্নীতিকে হাতিয়ার করা হচ্ছে – এটাই দুর্নীতির একটা বড়সড় ধরন।

অন্য সব কথা, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রমাণসাপেক্ষ তথ্যপ্রমাণের দিকে না গিয়ে রাহুল গান্ধী যে বলছেন চৌকিদার চোর হ্যায় তা তো এই আচরণ থেকেই স্পষ্ট।

এমনকি গত মাসে কলকাতায় যে সভা হল সেখানে তো বিজেপির সংসদ সদস্য শত্রুঘ্ন সিনহার গলাতেও সেই চোরের অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

এখন একটা ব্যাপার সকলেই জেনে গেছেন যে শোনা যাচ্ছে রাফাল চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হস্তক্ষেপ করেছিল এবং অভিযোগ উঠেছে তারাই অনিল আম্বানির সংস্থার দিকে ঝুঁকেছিল। প্রয়োগগত ক্ষেত্রে অনুপুঙ্খ যে সব বিষয় নিয়ে প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি প্রশ্ন তুলে তাকে ‘বেদনাদায়ক ও নজিরবিহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন, সে সব নিয়ে সাধারণ লোকের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাঁর কাছে যেটা স্পষ্ট তা হল যে ধরনের বাড়তি আগ্রহ একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দেখা গেছে তা কখনোই নিঃস্বার্থ ও দাতব্য হতে পারে না। এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে রাফালের ক্ষেত্রে যে সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সেই সংস্থার বিমানের ক্ষেত্রে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের (এইচএএল বা হ্যাল) মতো পারদর্শিতা ও দক্ষতা কোনওটাই নেই তা সত্ত্বেও দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র অনিল আম্বানির সুনামের উপরে ভিত্তি করে এবং তা ঘটেছে আবেগ ও দাতব্য করার অদম্য ইচ্ছা থেকে।

hal-2_021319040607.jpgঅনিল আম্বানির সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে হিন্দুস্তান এরোনটিক্সকে এড়িয়ে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তবে কেন, সে কথা স্পষ্ট নয়। (উৎস: পিটিআই)

শোনা যাচ্ছে, যে টাকায় চুক্তি হয়েছিল তার চেয়ে তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে এয়ারক্র্যাফ্ট কেনা হয়েছে এবং এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে তাতে নাকি দেশের খুব লাভ হয়েছে তবে এর সঙ্গে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে আমাদের ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ ধারনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

নির্দিষ্ট কয়েকটি নথি প্রকাশ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রক নিজেই নিজেকে বাহবা দিচ্ছে, এ থেকে স্পষ্ট যে কোনও কিছুর আশঙ্কা করেই তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে শুরু করে দিয়েছে, মনস্তাত্ত্বিক বিচারে এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটা দিক।

যখন কোনও কারণে আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন সর্বদাই নিজেকে রক্ষা করার কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

এটা অতি সাধারণ ব্যাপার যে যখন কেউ কোনও আশঙ্কার মধ্যে থাকেন তখন নিজেকে আহত প্রমাণ করার জন্য তিনি উঠেপড়ে লাগেন। বাস্তবে দেখা যায় যে এটা অপরাধীদের একটা লক্ষণ।

আমার মনে হয়, রাফাল নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর হাতে কাদা লেগেছে কি লাগেনি সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় – অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এত অস্পষ্টতা দেখে আমার কৌতূহল হল দুর্নীতি নিয়ে মোদী যে ধারনা পোষণ করেন সেটি কী, তা নিয়ে।

আমি বিশ্বাস করি, সারা দেশের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা স্পষ্ট ভাবে বোঝা জরুরি।

rafale_3_021319040649.jpg৩৬টি রাফাল জেট কেনা নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে তা নিয়ে যে প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। (সূত্র: রয়টার্স)

এক একজন ব্যক্তি দুর্নীতির এক একরকম অর্থ তৈরি করেন। যাঁরা নীতিগত ভাবে ‘সততা’র বুলি আউড়ে থাকেন তাঁদের নিরিখে বলা যায় সরকারি চুক্তি সর্বসমক্ষে অসত্য বলা বলা বা তথ্য বিকৃত করে পরিবেশণ করাকেও দুর্নীতি বলা যেতে পারে।

তবে যাঁরা আদর্শগত ভাবে সত্বাগত ভাবে ‘বিশুদ্ধতা’ নিয়ে ভাবিত তাঁদের কাছে এটা কোনও দুর্নীতি নয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যাঁরা মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ তাঁদের কাছে ভিন্ন ধর্মে বিবাহ কোনও খারাপ ব্যাপার নয় – কিন্তু যাঁরা জাতিগত ও ধর্মীয় ভাবে এই বিষয়টি কোনও ভাবে বরদাস্ত করতে পারেন না তাঁদের কাছে এটা খুব বড় একটা অপরাধ এবং অপরাধের বহিঃপ্রকাশও বটে। ভারতকে যাঁরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্যবাদী গণতন্ত্র’ বলে গ্রহণ করেছেন তাঁদের কাছে ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে এটি কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু যাঁরা হিন্দু রাষ্ট্রের পূজারী তাঁরা এর মধ্যে মহামারী দেখতে পান – যেমন ভাবে হিটলারের জার্মানি দেখেছিল যে ইহুদিরাই যত নষ্টের মূল।

আমি ২০১৪ সাল ফিরে দেখব এবং সততা সম্বন্ধে তাঁর ধারনার যে সূত্র নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন সে জন্য তাঁকে কৃতিত্বও দেব।

তাঁর সবচেয়ে জোরালো ও স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’। কংগ্রেসকে তুলে ধরা হয়েছিল দুর্নীতির (পড়ুন দূষণের) উৎস হিসাবে, তবে তা ছিল হিন্দুত্বের নিরিখে সততা সম্বন্ধে ধারণার প্রেক্ষিতে।

তবে এ কথা আমি একেবারেই বলছি না যে কংগ্রেস ছিল দুর্নীতিমুক্ত।

nehru-690_0211190233_021319040733.jpgবিজেপির মতে জওহরলাল নেহরু ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা। (সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস)

আমার বক্তব্য হল, সঙ্ঘ পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুয়ায়ী কংগ্রেসের দুর্নীতির সবচেয়ে উবড় দিকটি হল কোনও ব্যাপারে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া নয়, তা হল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুমুখিতা ও ধর্মনিরপপেক্ষতার প্রতি তাদের আদর্শগত দায়বদ্ধতা।

যেটা আসল কথা তা কংগ্রেস কী করেছে -- অর্থাৎ বাহ্যিত ভাবে দুর্নীতির অভিযোগ – তা নয়, আসল কথাটা হল কংগ্রেস কী সেটাই।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে আরএসএস এবং বিজেপির কাছে জওহরলাল নেহরু হলেন সাক্ষাৎ ‘দুর্নীতি’, তার কারণ হল তিনি কোন আদর্শকে সামনে রেখে চলতেন।

সর্দার পটেলের মূর্তিকে গঙ্গাজলের মতো পবিত্র বলে মনে করা হয় যেন তিনি নেহেরুর সমস্ত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ‘দূষণ’কে ধুয়ে শুদ্ধ করে দিতে পারবেন। তার কারণ হল হিন্দু মহাসভার নীতিতে ‘দুর্নীতি’ দেখতেন গান্ধী এবং সে জন্য তাঁকে মহৎ ও ভারতের জন্য গুরুত্বপপূর্ণ বলে বলে মনে করতে পারেননি নাথুরাম গডসে ও তাঁকে গডসে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

সততা নিয়ে মোদীর যে দৃষ্টিভঙ্গি তা আসলে আদর্শগত শুদ্ধতার সমার্থক, হিন্দুরাষ্ট্র হল এর একটা দৃষ্টান্ত, তাই তিনি রাফাল চুক্তি নিয়ে বসতে পারেন এবং সেখানে হস্তক্ষেপ বা কারচুপি করতে পারেন। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে, দুর্নীতি প্রকাশ করার চেষ্টা করা নিয়ে যে আদর্শগত ধিক্কার জন্মেছে – তা সত্যি হোক বা ধারণা হোক – সেটাই এর কারণ।

সততা ও বিশুদ্ধতা নিয়ে এই যে ধারনা, সেখানে বাস্তবিক দুর্নীতি তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয় যখন সেটি কারও বিপক্ষে যায়।

hindu-690_0211191116_021319040847.jpg দুর্নীতি ও বিশুদ্ধতা নিয়ে মোদীর ধারণা সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক, অর্থনীতি থেকে সেটি বহু যোজন দূরে। (উৎস: রয়টার্স)

মোদী সবচেয়ে নিপুণ ভাবে যে কাজটি করেছেন তা হল, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ওই অস্ত্রটি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবেন না, কারণ দুর্নীতি নিয়ে তাঁদের ধারণা মোদীর উপরে তাঁরা প্রয়োগ করতে পারবেন না।

অনিল আম্বানির মতো বড় কর্পোরেটকে কোনও কিছু পাইয়ে দেওয়া, সোজা কথায় কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া বা কাউকে অনুগত করে নেওয়া তাদের কাছে ‘দুর্নীতি’ নয় – রাজনৈতিক অভিধা অনুযায়ী অমিত শাহ-মোদী মোটামুটি ভাবে জনগণকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।

তাঁদের ধারনা যে অতীব সুস্পষ্ট তা উত্তরপ্রদেশে তাঁরা মেলে ধরতে পেরেছেন, উদারহণস্বরূপ বলা যায়, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা বিজেপির প্রার্থীতালিকায় কোনও মুসলমানের নাম না রেখে তালিকাটি পরিশুদ্ধ করে নিয়েছেন।

আদর্শগত শুদ্ধতাই যে সততা -- আগামী দিনে এই ধারণা আরও গভীর হবে – যদি না আগামী সাধারণ নির্বাচনে উপযুক্ত ভাবে এই মারাত্মক রাজনৈতিক ধারনাটিকে সুস্পষ্ট ভাবে বাতিল না করে দেয়।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SWAMI AGNIVESH SWAMI AGNIVESH

Author is a social activist.

Comment