সংখ্যা কমছে পরিযায়ী পাখির: সমস্যা এ দেশে নয়, বিদেশে
সরকারি ভাবে স্বীকার না করলেও চিন যে সমূলে গিস নিধন করে তা এখন 'ওপেন সিক্রেট'
- Total Shares
পরিযায়ী পাখি নিয়ে লিখতে বসার সমস্যা বিস্তর। আমাদের এদিকে, মানে পশ্চিমবঙ্গ বা পূর্ব ভারতে, কী ধরণের পরিযায়ী পাখি আসে সে সম্পর্কে মানুষের খুব একটা সম্যক ধারণা নেই। অনেকেই মনে করেন শীতকালে এ চত্বরে সাইবেরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বা ক্যাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়।
হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে বা পূর্ব ভারতে কী ধরণের পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
এ তল্লাটের পরিযায়ী পাখিরা
আমাদের এদিকে যে পরিযায়ী পাখিটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেই পাখিটির নাম সরাল। শুনলে অবাক হবেন এই সরাল পাখি কিন্তু বিদেশ থেকে আসে না। এই পাখি এ দেশেই পাওয়া যায়। শীতের মরসুমে মূলত প্রজননের জন্য এদের পূর্ব ভারতে আগমন ঘটে।
এছাড়া আমাদের এই অঞ্চলে ভিন দেশ থেকে বেশ কিছু পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। এই পাখিগুলো মূলত হিমালয়ের উত্তর পূর্ব প্রান্তের দেশগুলো থেকে আসে - যেমন চিন, মঙ্গোলিয়া কিংবা তিব্বত।
যে পরিযায়ী পাখিটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেই পাখিটির নাম সরাল
বাসস্থানের দিক থেকেও পরিযায়ী পাখির রকমফের রয়েছে। যেমন কিছু পরিযায়ী পাখি রয়েছে যারা 'পার্চিং বার্ড'। এরা দলে থাকে না বা জোট বেঁধে থাকে না বলে এই প্রজাতির অনেক পাখিকেই অধিকাংশ মানুষ চেনেন না। আবার কিছু পরিযায়ী পাখি রয়েছে - যেমন রাজহংসী বা গিস - যারা দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। এই পরিযায়ী পাখিগুলোর কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা দীঘি বা পুকুর পাড়ে থাকে আবার কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা সমুদ্রতটে থাকে।
বিদেশ থেকে আগত কয়েকটি পরিযায়ী পাখি রয়েছে যারা হয়তো বছরের বেশির ভাগ সময়টাই এ দেশে কাটায়। হয়ত বছরে মাত্র মাস তিনেক বিদেশে (স্বদেশে) কাটায়। তাহলে তাদেরকেও আমরা পরিযায়ী (এ দেশের নিরিখে) পাখি বলি কেন? কারণ এই পাখিগুলো প্রজনন করে বিদেশে। অনেকটা আমাদের দেশের নিয়মের মতোই -- যে দেশে জন্ম সেই দেশের নাগরিক।
পরিযায়ীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে
পক্ষী বিশারদদের অনুমান যে এ দেশে আগত পরিযায়ী পাখিদের, বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। 'অনুমান' শব্দটি ব্যবহার করার পিছনে একটি কারণ রয়েছে। সে বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। কিন্তু এই অনুমনাটি সত্যি। অন্তত খালি চোখে তাই তো দেখা যাচ্ছে।
পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে কেন? অনেকেই মনে করেন যে এখানে বাসস্থান সংকুচিত হওয়ার ফলে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমেছে। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় এবং কোনও মতেই প্রধান কারণ নয়। এই কারণটিকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে।
পরিযায়ী পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে [ছবি: সুবীর হালদার / ইন্ডিয়া টুডে]
তাহলে প্রধান কারণটা বা প্রধান কারণগুলো কী কী? এ বিষয় নানা মুনির নানা মত।
ব্যক্তিগত ভাবে পক্ষী বিশারদ হিসেবে আমি মনে করি যে দেশগুলো থেকে এই পাখিগুলো আসে বা যে দেশের উপর দিয়ে এই পাখিগুলো এ দেশে আসে মূল সমস্যা সেই দেশগুলোতেই রয়েছে। রাজহংসী বা গিস জাতীয় হাঁস প্রজাতির পাখিগুলো থেকে এইচ১ভি১ ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক রয়েছে। তাই এই পাখিগুলোকে বেশি মাত্রায় নিধন করা হয়। চিন সরকারি ভাবে স্বীকার না করলেও, সে দেশে রাজহংসীকে যে সমূলে নিধনের প্রচেষ্টা হয়েছে তা এখন 'ওপেন সিক্রেট'।
এছাড়া যে সব পাখির মাংস সুস্বাদু সেই পাখিদের শিকারের উদ্দেশ্যে হত্যা করার প্রবণতা রয়েছে। আর, এই প্রবণতা ভারতের থেকে অনান্য দেশে অনেক বেশি। ভারতে এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে কিছু হলেও সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে এ বিষয়ে কড়া আইন রয়েছে এবং সেই আইন প্রয়োগও করা হয়।
এ দেশে বাসস্থানের অভাবে পরিযায়ী পাখিরা আসা বন্ধ করে দিয়েছে এই ধরণটা অর্ধসত্য। আগেও বলেছি পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থান বিভিন্ন ধরণের হয়। কেউ চাষের ক্ষেতে থাকে কেউ আবার পুকুর, দীঘি, নদী বা সমুদ্রের উপকূলে। একটা দীঘি বা পুকুর বুজিয়ে দেওয়া হয় তাহলে এক ধরণের পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমবে। কিন্তু অন্য ধরণের পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়তে বাধ্য। বাস্তবে সেটাও তো হচ্ছে না। একমাত্র যে পাখিদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা নেই বা যে পাখিগুলোর মাংস সুস্বাদু নয় সেই পাখিগুলোর সংখ্যা ঠিক রয়েছে।
প্রতিবছর হাওড়ার সাঁতরাগাছি ঝিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে [ছবি: সুবীর হালদার / ইন্ডিয়া টুডে]
তবে বাসস্থানের প্রভাব এ অঞ্চলে কিছুটা হলেও পরিযায়ী পাখিদের উপর পড়েছে। একটা সময় চিড়িয়াখানায় পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিশেজ্ঞরা এর কারণ শনাক্ত করে বলেছিলেন যে চিড়িয়াখানার ভিতরে জলাশয়টির চারিপাশ বাঁধিয়ে দেওয়ার ফলে এই বিপত্তি।
বছর কয়েক আগে সাঁতরাগাছি ঝিলে একটিও পাখি আসেনি। এর কারণ ঝিলের কচুরিপানা সাফ করে ফেলা। সাধারণ ভাবে একটি ঝিলের ৭০ শতাংশ মতো কচুরিপানা সরিয়ে ফেলে বাকি ৩০ শতাংশ রেখে দেওয়া উচিত। কিন্তু সে বছর প্রায় ৯০ শতাংশ কচুরিপানা সাফ করে দেওয়া হয়েছিল।
সমস্যাটা হলো, ঝিলের রক্ষণাবেক্ষণ যাঁদের দায়িত্বে রয়েছে তাঁরা এই বৈজ্ঞানিক কারণগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
গবেষণা হয় না কেন
আগেই বলেছি আমরা শুধু অনুমান করি যে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমেছে। এর কারণ, অনুমান করা ছাড়া উপায় নেই। সংখ্যা কমেছে বা বৃদ্ধি হচ্ছে এটা নির্ণয় করতে হলে তো আসল সংখ্যাটির প্রয়োজন রয়েছে, যার উপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হবে যে সংখ্যা বেড়েছে না কমেছে। সেই সংখ্যাটিই তো নেই। কারণ কোনও দিনও গবেষণা করে সেই সংখ্যা নির্ণয় করা হয়নি এ দেশে। এবং শুধু পরিযায়ী নয়, কোনও পাখির ক্ষেত্রেই এই সংখ্যা নির্ণয় করা হয়নি। সহজ সরল বাংলায় বাঘ সুমারির মতো পাখি সুমারির কোনও ব্যবস্থা নেই এ দেশে।
এ দেশে পাখি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়না [ছবি: রয়টার্স]
এই না থাকার পিছনে দুটি কারণ:
প্রথমত এ দেশে পাখি বিশারদ হয়ে ওঠে এখনও পেশা হয়ে ওঠেনি, পুরোটাই নেশা। ভারতের মতো বড় একটি দেশের অনুপাতে পক্ষী বিশারদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। যার ফলে তাঁদের পক্ষে না দেশ জুড়ে বা কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে না গণনা করা সম্ভব, না দেশের অধিকাংশ মানুষকে সচেতন করা সম্ভব। ইংল্যান্ডের মতো দেশে বাড়িতে বাড়িতে পাখি চেনেন এমন লোক রয়েছে। তাঁরা বাগানে বসে পাখি গুণে নির্দিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। এই সংখ্যাগুলোকে একত্রিত করে সরকারি ভাবে সে দেশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।
দ্বিতীয়ত এই ধরণের গবেষণা চালাতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু পাখি নিয়ে গবেষণা করার জন্য এ দেশে অর্থ প্রায় মঞ্জুর করাই হয় না। যাঁরা করতে চান তাঁদের নিজের উদ্যোগেই করতে হয়।
আসলে ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, রাজারাজড়ারা ছাড়া নেশা তাড়া করে বেড়ানো সম্ভব নয়, বিশেষ করে সেই নেশা যদি ব্যয়বহুল হয়।
পাখি নিয়ে গবেষণা করা বেশ ব্যয়বহুল নেশা আর এই নেশার জন্য অর্থ যোগানের মতো কোনও 'রাজা'ই ভারতে নেই।